“হুম। লোকজনের মুখে শুনেছিলাম ওখানকার খাবার নাকি খুব ভালো। কিনতু আমার কাছে তেমন ভালো লাগে নি,” গুড়ের চায়ে চুমুক দেবার আগে বললো সে।
লুঙ্গি পরা কাস্টমারের মতো দোকানিও অবাক হলো কথাটা শুনে। এখন পর্যন্ত কেউ এরকম কথা বলে নি। ঐ ডাইনিটার শত্রুরাও এ কথা বলতে সঙ্কোচ বোধ করে।
“কি কন?” বিস্মিত কাস্টমার বললো। “ওইখানকার খাওন খাইতে কতো দূর থেইকা লোকজন আসে…কতো নামডাক…আর আপনে কইতাছেন ভালা লাগে নাই!”
“আরে মিয়া, উনার ভালা না লাগলেও কি কইতে হইবো ভালা লাগছে?” রহমান কিছুটা মেজাজের সাথেই বললো। “খাওন-দাওনের ব্যাপার..সব খাওন সবার ভাল লাগে এ কথা ঠুনছো কুনোদিন?”
“না, মাইনে,” লোকটার বিস্ময় এখনও কাটছে না, “কেউ তো খারাপ কয় না।”
“কয় না আবার কি? এই যে উনি কইলেন এহন।”
“আমার যে খুব খারাপ লেগেছে তা নয়,” বললো শহুরে লোকটি। “আসলে যে-রকম নামডাক শুনেছি খাবার খেয়ে সে-রকম মনে হয় নি। এই আর কি।”
“আপনে নিজে খাইছেন, আপনে কইতেই পারেন ভালমন্দ। কেউ তো আর অন্যের মুখে খায় না, কি ক?”
মুচকি হাসলো সে। এই দোকানি ঠিকই বলেছে। কেউই অন্যের মুখে খায় না।
“খাওন ভালা লাগে নাই ক্যান আপনের?” হ্যাংলা জানতে চাইলো।
“আমার মনে হয়েছে ওখানকার খাবারের চেয়ে ভাবই বেশি। আর এটাই মানুষকে মুগ্ধ করে।”
“এক্কেবারে ঠিক কইছেন,” রহমান মিয়া বললো। “ভাব দেখেন …দিছে। ভাতের হোটেল আর নাম রাখছে রবিঠাকুর!”
মুচকি হাসলো সে।
“রবিঠাকুর না…রবীন্দনাথ এইহানে কুনোদিন খাইতে আসেন নাই!” দোকানির ভুল শুধূরে দিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো হ্যাংলা মতোন লোকটি।
“ঐ ব্যাটা কবে মইরা ভূত…সে ক্যান এইহানে খাইতে আইবো?”
“আরে মিয়া আসে নাই দেইখাই তো ইমুন নাম রাখছে।”
“যত্তোসব বুজরুকি।”
“চ্যাতে ক্যান, মিয়া? আরে একটু ইস্টাইল করছে, বুঝো না?”
“ইস্টাইল না ছাই,” বিরক্ত হয়ে বললো রহমান। “ভাব লইছে।”
“ইসটাইল মাইনে তো ভাব লওয়াই। হে তো তোমার মতো মুকখু-শুকখু মানুষ না। বিরাট শিক্ষিত। দেমাগে মাটিতে পা ফালায় না। তার উপরে জমিদারের বৌ…একটু ভাব লইবারই পারে।”
“অ্যাতো শিক্ষিত হইলে ভাতের হোটেল খুলছে ক্যান, অ্যাঁ?” রহমান রেগেমেগে বললো। “আর জমিদারের বৌ হে কেমনে অয়? জমিদারের কুনো ঠিক-ঠিকানা নাই বৌ আয়া নাড় গাঁড়ছে এই সুন্দরপুরে!”
“রহমান মিয়া, আস্তে কও, ঐ বেটির কানে গেলে তোমার টঙ চাঙ্গে উঠায়া দিবো,” হ্যাংলা বললো ইঙ্গিতপূর্ণভাবে। “হের ঘাটে কইলাম বাঘে মহিষে একলগে খানা খায়। একটু আগে একটা মহিষ আইছে,” কথাটা বলেই চোখ টিপে চায়ের কাপ রেখে উঠে দাঁড়ালো সে। “যাই, মহিষটার লগে একটু দেখা কইরা আসি। চায়ের দামটা লেইখা রাইখো।”
“ইতরের বাচ্চা!” আতর আলী রাস্তার দিকে পা বাড়াতেই তিক্তমুখে অসফুটস্বরে বলে উঠলো রহমান।
“কিছু কইলা নাকি, মিয়া?” পেছন ফিরে বললো আতর।
“না। তুমারে না…কইলাম পিপড়ার বাচ্চা! ধুর, অ্যাতো পিপড়া ক্যান গুড়ের মইদ্যে?” সত্যি সত্যি গুড় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলে চায়ের দোকানি।
বাঁকা হাসি হেসে হ্যাংলা চলে গেলো রবীন্দ্রনাথের দিকে।
“কাম-কাইজ কিছু করে না, খালি মাইনষের খবর নিয়া থাকে,” গজগজ করতে করতে বললো রহমান। “হাদে কি সবতে কয় বিবিচি।”
“বিবিচি মানে?” চায়ে চুমুক দিয়ে বললো শহুরে লোকটি।
“ঐযে রেডিওর খবর আছে না, বিবিচি?”
“ও,” বুঝতে পারলো সে। সঙ্গে সঙ্গে চায়ের কাপটা রেখে উঠে। দাঁড়ালো। “কতো হয়েছে আমার?”
“একশ ষাইট।”
পকেট থেকে দুশ’ টাকা বের করে বাড়িয়ে দিলো দোকানির দিকে। নোট দুটো হাতে নিয়ে রহমান বললো, “হালায় কুনো কাম-কাইজ করে না, পুলিশের ইনফর্মার, বুঝলেন?”
“হুম,” মাথা নেড়ে সায় দিলো কাস্টমার।
“দুনিয়ার সব খবর রাখে ইতরের বাচ্চা…এইহানে কুন লোকের পাছায় খাজলি আছে তাও হে জানে!”
মুচকি হেসে ভাঙতি টাকাগুলো পকেটে ভরে সে আবারো পা বাড়ালো রবীন্দ্রনাথের দিকে।
রহমান মিয়া সেদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলো, “মুখে তো কইলো খাওন ভালা না…এহন দেহি ওইদিকেই যায়! মাইষে কী আর হাদে কয়, ঐ বেটি সবৃতেরে জাদু কইরা ফালায়!”
.
অধ্যায় ২
রবীন্দ্রনাথের বড় দরজাটা দিয়ে ভেতরে উঁকি মেরে যে-ই না দেখলো এসপিসাব নেই সঙ্গে সঙ্গে আতরের ঠোঁটে লম্পটমার্কা হাসি ফুটে উঠলো।
ছ্যাদা পাইলে ব্যাটামানুষের হুঁশ থাকে না। খালি ছ্যাদার মইদ্যে হান্দাইতে চায়!
সেই হাসি মুখে লাগিয়ে রেখেই বাইরে পার্ক করা এসপির গাড়ির সামনে চলে গেলো সে। এসপি’র ড্রাইভার গান শুনছে, তার সাথে কথা বলতে গেলে সুবিধা করতে পারলো না। আতরের সালামের জবাবে বিরক্তমুখে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। মুসলমান হয়ে আরেক মুসলমানের সালাম নেয়াটা ফরজ, কিন্তু এই ফরজ কাজটা বাদ দিয়ে হারামজাদা হিন্দিগান শুনতেই বেশি মনোযোগী। চুতমারানির পোলা, মনে মনে গালিটা দিয়ে যেই না কয়েক পা বাড়িয়েছে অমনি থমকে দাঁড়ালো সে।
“আতর আলী?”
পেছন থেকে কেউ তার নাম ধরে ডেকেছে। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেলো একটু আগে রহমান মিয়ার টঙের সেই কাস্টমারকে। লোকটা সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো আতর।