“গুড় ইটটু বাড়ায়া দিও..তুমি কইলাম দিন দিন কিপ্টা হইয়া যাইতাছো। মিয়া…গুড় দিবারই চাও না। পারলে গরম পানি গুলায়া খাওয়াইয়া দিবার চাও।”
একমাত্র কাস্টমারের দিকে চকিতে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দিলো রহমান। “এতো মিষ্টি খাইলে ডাইবিটিস হইবো।”
“ঐসব বড়লোকি রোগ আমাগো হইবো না।”
“রোগশোক কি বড়লোক-ছোটোলোক দেহে নি,” রহমান মিয়া চায়ে গুড় মেশাতে মেশাতে বললো।
“দেহে না তো কি,” তর্ক জুড়ে দেবার জন্য বললো কাস্টমার। “এই ধরো-”
“বেনসন আছে?”
কাস্টমারে কথা থেমে গেলো। রহমান মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলো ভদ্রগোছের এক লোক দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। মাঝারি উচ্চতা, পরিপাটি পোশাক, চোখেমুখে কেমন খবরদারি করার ভঙ্গি। দেখেই বোঝা যায় শহর থেকে এসেছে। মুখটা চেনা চেনা লাগলো। হূম, তার মনে পড়েছে। সম্ভবত কয়েক ঘণ্টা আগে এই লোককেই দেখেছে ঐ হোটেলে ঢুকতে হলুদ রঙের ট্যাক্সিতে করে এসেছিলো। বাইরে দাঁড়িয়ে ভালো করে দেখছিলো হোটেলটি। খেয়েদেয়ে যখন বের হয়ে যাচ্ছিলো তখন দেখেছে লোকটার মুখে কেমন তৃপ্তির আভা লেগে রয়েছে। ওখান থেকে বের হওয়া সব কাস্টমারেরই একই অবস্থা হয়। এ আর নতুন কি। কয়েক বছর ধরেই তো দেখছে এ দৃশ্য।
“আছে,” ছোট্ট করে বললো দোকানি।
“এক প্যাকেট দিন।”
রহমান মিয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। রবীন্দ্রনাথের ঠিক পঞ্চাশ গজ দূরে রাস্তার ওপারে ছোট্ট একটি চা-বিস্কুটের টঙের মালিক। বড় আর ক্ষমতাবানের সামনে দুর্বল-গরীবেরা যেমন কুঁকড়ে থাকে, তেমনি তার টঙ দোকাটিও কাচুমাচু হয়ে মাথা নুইয়ে থাকে সব সময়, যদিও বয়সে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে কয়েক বছরের বড়!
ওই রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়েদেয়ে যারা বের হয় তারা এতোটাই তৃপ্ত থাকে যে, খুব কম সময়ই তার দোকানে এসে চা-সিগারেট খায়, এক প্যাকেট বেনসন-ফাইভ-ফাইভ চাওয়া তো দূরের কথা। তাই সিগারেটের কার্টন থেকে প্যাকেটটা বের করতে করতে মনে মনে লাভের হিসেবটা না করে পারলো না সে। অঙ্কটা খুব সহজ-প্রতিটি সিগারেটে যদি এক টাকা লাভ হয় তাহলে এক প্যাকেটে পুরো বিশ টাকা।
নতুন কাস্টমার, যে কিনা একটু আগে রবীন্দ্রনাথে এসেছিলো, প্যাকেটটা হাতে নিয়েই একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললো। আরেক কাপ চা। বিক্রি হবার সম্ভাবনা দেখতে পেলো রহমান। লোকটার তীক্ষ্ণণদৃষ্টি আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দোকানের সামনে দুটো কাঠের বেঞ্চের একটাতে বসে আছে একটু আগে আসা হ্যাংলা মতোন লুঙ্গি পরা মাঝবয়সী কাস্টমার, তাকেও চকিতে দেখে নিলো সে।
“রঙচা হবে?”
“হইবো।”
“এক কাপ দিন। চিনি কম।” বেঞ্চে বসে পড়লো সে।
“গুড়ের চা দেই? এক্কেবারে খাঁটি গুড়…কুনো ভেজাল নাই।”
রহমান মিয়ার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিলো নতুন কাস্টমার।
লুঙ্গি পরা কাস্টমারে দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিলো দোকানি। “লও”
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে সিগারেট খেতে থাকা ভদ্রলোককে পা থেকে মাথা পর্যন্ত মেপে নিলো সে। সশব্দে চুমুক দিলেও তার চোখ এক মুহূর্তের জন্যেও সরছে না নতুন কাস্টমারের উপর থেকে।
রহমান মিয়া এবার আরেক কাপ গুড়ের চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এমন সময় টঙ দোকানের পাশ ঘেষে একটি সাদা প্রাইভেটকার চলে গেলো রবীন্দ্রনাথের দিকে।
“এসপিসাব আইছে মনে হয়, প্রথম কাস্টমার বললেও রহমান কোনো জবাব দিলো না। “আইজ তো বিসুদবার…পুরা হাট বইসা যাইবো। এমপি সাবেও আইছে হুনলাম। মনে হয় ডাইরেক্ট ঐ বাড়িতে গেছে,” সশব্দে চায়ে চুমুক দিয়ে রহস্যময় হাসি দিলো হ্যাংলা।
রহমান মিয়া চা বানাতে বানাতে বললো, “সব খবরই দেহি থাকে তুমার কাছে।”
কথাটা আমলে নিলো না হ্যাংলা, নতুন কাস্টমারের দিকে মনোযোগ দিলো। “ভাইজান কি নতুন আইছেন এইহানে?”
“হুম,” সিগারেটে টান দিয়ে বললো সে। রবীন্দ্রনাথের সামনে পার্ক করা। গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে এখনও।
“আপনেরে দেইখাই বুঝছি ক্যান আইছেন৷” লুঙ্গি পরা লোকটি হেসে বললো।
হ্যাংলার দিকে ভুরু কুচকে তাকালে শহূরে লোকটি। একটু অবাকই হলো যেনো। “কেন এসেছি?”
“ঐ হোটেলে খাইতে আইছেন।” হ্যাংলা তার হলদে দাঁত বের করেই রেখেছে, বন্ধ করার নাম নেই।
কথাটা শুনে সঙ্গে সঙ্গে অভিব্যক্তি বদলে গেলো তার, মুচকি হেসে মাথা দোলালো। “না। অন্য একটা কাজে এসেছি।”
“ও” হলদে দাঁতগুলো আড়ালে চলে গেলো। “তয় একবার ওইখানে গিয়া টেস্ট কইরা আইতে পারেন…অনেক দূর থেইকা লোকজন আসে খাইতে। মেলা নাম-ডাক।”
“উনি ওইখানে খাইছেন, তোমারে আর কইতে হইবো না,” শহুরে কাস্টমারের দিকে চায়ের কাপটা বাড়িয়ে লুঙ্গি পরা লোকটিকে বললো। রহমান। “অইন্যের তল না পিটায়া নিজের ঢোল পিটাও।”
হ্যাংলা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে তাকালো দোকানির দিকে, কী বলবে কথা খুঁজতে লাগলো।
চায়ের কাপটা নিয়ে দোকানির দিকে তাকালো শহূরে কাস্টমার। দুপুরের পর যে এখানে এসেছিলো তা এই দোকানি দেখেছে। মহাসড়কের পাশে নিরিবিলি জায়গায় ছোট্ট একটি টঙ দোকান, দেখেই বোঝা যায় দিনের বেশিরভাগ সময় আক্ষরিক অর্থেই মাছি মারে এই লোক। তার উনমুক্ত গুড়ের চাকতির উপরে এখনও ভনভন করে কিছু মাছি ঘোরাফেরা করছে আর সে অভ্যাসবশত বার বার হাত নেড়ে তাড়াচ্ছে ওগুলো। এমন লোকের আগ্রহ যে সামনের রেসটুরেন্টের দিকেই বেশি থাকবে সেটাই স্বাভাবিক।