পাঁচ মিনিট পর খালি সুপের বাটিটার দিকে তাকিয়ে এই প্রথম তার মনে প্রশ্ন জাগলো এটা কিসের সুপ? নিজে নিজে উত্তরটা জানার চেষ্টা করলো কিন্তু নিশ্চিত হতে পারলো না। একটা ব্যাপারে সে পুরোপুরি নিশ্চিত, এ জীবনে টাটকা সবুজ রঙের সুপ কখনও খায় নি।
এটা কি সুপ অব লাইফ? মেনুতে এরকম কিছু দেখেছিলো। হতে পারে। জীবনের রঙ তো সবুজই হওয়ার কথা। সম্ভবত রঙের কারণে সুপের এমন নামকরণ।
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। কোমরের বেল্টটা একটু আলগা করে নিলে ভালো হয় কিনতু সেটা করতে ইচ্ছে করছে না। এরকম কাজ অন্য কাউকে করতে দেখলে তার হাসি পায়। পর পর তিনটি ঢেকুর উঠলো এবার। তৃপ্তির ঢেকুর। টের পাচ্ছে তার শরীরটা কেমন রিল্যাক্স হয়ে গেছে। ভ্রমণের ক্লান্তি কোথায় উড়ে গেছে কে জানে। চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে। ভর দুপুরে ঘুমানোর অভ্যেস তার নেই কিন্তু আজ খুব ইচ্ছে করছে। আরো দু তিনটি ঢেকুর দেবার পর ড্রিঙ্কসের গ্লাসটা হাতে তুলে নিলো। সাদা। চিনেমাটির গ্লাস বলে ড্রিঙ্কসের রঙটা এতোক্ষণ চোখে পড়ে নি। গাঢ় সোনালি রঙের ড্রিঙ্কস দেখে আরেকবার বিস্মিত হলো সে।
গোল্ডেন পন্ড ড্রিঙ্কস! মেনুতে এটাই তো লেখা ছিলো? বুকভরে নিঃশ্বাস নিয়ে চুমুক দিলো ড্রিঙ্কসে। আবারো বিস্মিত হলো। এ জীবনে ঝাল, টক আর মিষ্টির মিশ্রনে কোনো ড্রিঙ্কস সে পান করে নি। সম্ভবত, বিভিন্ন ধরণের মসলাও দেয়া হয়েছে এতে। সব মিলিয়ে যে রাসায়নিক মিশ্রণটি তৈরি হয়েছে সেটা অজ্ঞাত, অব্যাখ্যাত। কিন্তু স্বর্গীয় স্বাদের।
খালি গ্লাসটি রেখে দিলো। অনুভব করলো সারা শরীরে এক ধরণের শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। ভালো লাগার একটি অনুভূতি। কেমন ঘোরলাগা এক আবেশে বসে রইলো মিনিটের পর মিনিট। সম্বিত ফিরে পেতেই চারপাশে তাকালো। কেউ নেই। যে তিনজন লোক দূরের টেবিলে বসে খাচ্ছিলো তারা চলে গেছে কখন টেরই পায় নি।
উদভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো সে। তার মধ্যে দেখা দিলো অস্থিরতা। “স্যার?”
চমকে উঠে পেছনের দিকে তাকালো। তার পেছন দিকে ডানপাশে ওয়েটার দাঁড়িয়ে আছে।
“আর কিছু খাবেন?”
“না।” ঢোক গিলে আবার বললো, “বিলটা নিয়ে-”।
তাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বিলটা টেবিলের উপর রেখে দিলো ওয়েটার। বিল দেখে অবাক হলো সে। মহাসড়কের পাশে রেসটুরেন্টগুলো ক্রেতাদের গলাকাটার জন্য কসাইর মতো ধারালো চাকু নিয়ে বসে থাকে, সেদিক থেকে দেখলে রবীন্দ্রনাথ বেশ ব্যতিক্রম।
তিনটা একশ’ টাকার নোট বের করে ওয়েটারের হাতে ধরিয়ে দিলো। “বাকি টাকা ফেরত দিতে হবে না। ওটা ভোমার বখশিস৷”
_ “সরি স্যার,” নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো ছেলেটি, যার বয়স পঁচিশের বেশি হবে না। “আমরা টিপস নেই না।”
“কি?” আবারো অবাক হলো সে। টিপস নেয় না? পাগল নাকি?
“এখানে ওয়েটারদেরকে টিপস দেয়া নিষেধ।”
চারপাশে চোখ বুলালো। “কেউ তো দেখছে না, রেখে দাও।” বলেই চোখ টিপে দিলো সে।
আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ চলে গেলো ওয়েটার।
“আজব জায়গা!” অস্ফুটস্বরে কথাটা বের হয়ে গেলো তার মুখ দিয়ে। উঠে দাঁড়ালো সে। অনেকদিন পর পরিপূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে খাবার খেয়েছে। দেহমনে অলস একটি ভাব চলে এসেছে এখন। তার মনে হচ্ছে আর কিছু করার আগে একচোট ঘুমিয়ে নিতে হবে। দরজা দিয়ে যে-ই না বের হয়ে যাবে অমনি পেছন থেকে সেই ওয়েটার তাকে ডাকলো।
“স্যার?”
ঘুরে তাকাতেই টাকাগুলো বাড়িয়ে দিলো তার দিকে। “তোমাদের খাবার কিন্তু সত্যি অসাধারণ,” বললো সে।
আলতো করে হাসলো ওয়েটার, যেনো এ-রকম প্রশংসা শুনে শুনে বহু আগেই তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
টাকাগুলো হাতে নিয়ে বললো, “অনেকদিন পর ভালো স্বাদের খাবার খেলাম।”
“থ্যাঙ্কস, স্যার,” সৌজন্যবশত বললো ছেলেটি।
“আমাকে না, তোমাদের মালিককে থ্যাঙ্কস জানিয়ে দিও আমার তরফ থেকে।”
“জি, স্যার। অবশ্যই জানিয়ে দেবো।”
থুতনীর নিচে চুলকে নিলো সে। “উনার পুরো নাম কি?”
ওয়েটার একটু চুপ থেকে বললো, “মুশকান জুবরি।”
“উনি কি এখানকার স্থানীয়?”
“এটা আমি জানি না, স্যার।” কথাটা বলেই চলে গেলো ওয়েটার।
পেছনের পকেটে মানিব্যাগটা ঢুকিয়ে নিলো সে। বুঝতে পারছে, তাকে আরো বেশি সতর্ক হতে হবে। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের কারো সাথে কথা বলার সময়!
.
অধ্যায় ১
সন্ধ্যার অন্ধকার নামার আগেই রাস্তার ওপারে জ্বলজ্বল করে উঠলো। রবীন্দ্রনাথ।
“ওয়াক থু!” সাইনটার দিকে তাকিয়ে শব্দ করে থুতু ফেললো রহমান মিয়া। যেনো বুকের ভেতরে দলাপাকানো ঘৃণা বেরিয়ে এলো।
“কিমিয়া, কারে থুতু মারলা?”
রহমান দেখলো ভুতের মতো কোত্থেকে যেনো হাজির হয়েছে অতিপরিচিত এক কাস্টমার। লোকটার মুখে দুষটুহাসি লেগে রয়েছে। ভরসন্ধ্যায় এর মতো কাস্টমার পেয়ে মোটেও খুশি হতে পারলো না। “কারে আবার মারুম…আজাইরা কথা..মুখে থুতু আইছিলো ফালায়া দিলাম,” বিরক্ত হয়েই বললো দোকানি।
“ঐ ডাইনিটার উপরে চেইতা আছে, জানি তো,” গুলখাওয়া লালচে দাঁত বের করে বললো কাস্টমার। “এহন তো আমি ছাড়া কেউ তোমার গুড়ের চা খায় না। খালি বিড়ি-সিগরেট বেইচা কি চলে।” আবারো লালচে দাঁতগুলো বিকশিত হলো।
গুড়ের চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো রহমান, কথাগুলো যেনো আমলেই নিলো না।