সিজন করা মোটা মোটা বাঁশ দিয়ে তৈরি এর দেয়ালগুলো। দুটো বেসিন আর একটি ইউরিনাল প্যান। পাশের একটি দরজায় লাগানো সাইন। দেখে বুঝতে পারলো ওটা মহিলাদের জন্য নির্ধারিতা।
শার্টের স্লিভ গুটিয়ে বেসিনের ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে ফেললো। সামনের আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখলো সে। আজ সকালে শেভ করা হয় নি। একদিন শেভ না করলেই তার মুখের দাড়ি বেশ বেড়ে যায়। বিশ্রি দেখায় তাকে। অর্ধেকের বেশি দাড়ি-গোঁফ পেকে গেছে মধ্যবয়সের আগেই। ইদানীং নিজেকে আরেকটু কমবয়স্ক দেখানোর জন্য প্রতিদিন শেভ করে, তবে আজ সেটা করতে ভুলে গেছিলো।
ভেজা হাতের আঙুল দিয়ে মাথার চুলগুলো আচড়ে নিলো। সে কখনও চিরুনী ব্যবহার করে না। তার হাতের চিকন আঙুলগুলো চিরুণীর চেয়েও বেশি ভালো কাজ করে। আয়নায় তাকিয়ে দেখলো নিজেকে। ভেজা চুলে তাকে বেশি হ্যান্ডসাম লাগে!
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে টেবিলের কাছে ফিরে এসে অবাক হয়ে গেলো। এরইমধ্যে খাবার চলে এসেছে। ধোঁয়া উঠছে মুক্তার মতো সাদা-সাদা ভাত থেকে। মুশকান’স কারি থেকে বের হচ্ছে অজ্ঞাত আর প্রলুব্ধকর সেই গন্ধ। ডালের বাটিটাও চোখ এড়ালো না। চমৎকার রঙ! এরকম চমৎকার রঙের ডাল সে কখনও দেখে নি। ঠিক হলুদ নয়, আবার বাসন্তি রঙও বলা যায় না। ডালের মধ্যে ভেসে আছে ছোটো ছোটো লাল-সবুজ মরিচের ফালি!
চেয়ারে বসে পড়লো। একটা প্লেটে তিন ধরণের ভতা। সবগুলোই বলের আকৃতিতে। বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টে এমনটিই দেখা যায় কিন্তু এখানে একটু ব্যতিক্রম আছে। ছোটো গলফ বলের মতো ভতার দলাগুলো তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
চোখ আর হাসিমুখটি বানানো হয়েছে দুটো লালচে দানা আর কেপসিকনের সরু-লম্বা একটি ফালি দিয়ে।
আনমনেই হেসে ফেললো। ক্ষিদের বায়না মেটাতে আর বেশি দেরি করলো না। ঝটপট খেতে শুরু করলো। খাবারগুলো তার গলা দিয়ে নেমে যাবার সময় বিমোহিত হয়ে গেলো এর স্বাদের কারণে।
দশ মিনিট পর আবিষ্কার করলো চারপাশের সবকিছু ভুলে সে শুধু খেয়েই যাচ্ছে। প্রচণ্ড খিদের সময় সব খাবারের স্বাদই ভালো লাগে কিন্তু স্বীকার করতে বাধ্য হলো, যে খাবার মুখে পুরছে তা সত্যি অসাধারণ। সামান্য ভর্তা থেকে শুরু করে ডাল পর্যন্ত অসম্ভব সুস্বাদু। আর মুশকান’স কারির কথা ভাষায় প্রকাশ করতে পারলো না। সত্যি বলতে, এটা গরুর নাকি খাসির মাংস সেটা ধরতে গিয়ে হিমশিম খেলো। কার কাছ থেকে যেনো শুনেছিলো, ভালোভাবে রান্না করলে গরু আর খাসির মাংসের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। আরো অবাক হলো, গরুর মাংসে যে কটু একটা ঘ্রাণ থাকে সেটা নেই। সম্পূর্ণ নতুন একটি গন্ধ নাকে আসছে আর সেটা খাবারের রুচি আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
যে খাবারগুলো দেয়া হয়েছিলো তার সবগুলো শেষ করে আঙুল চাটতে চাটতে আশেপাশে তাকালো। ওয়েটারকে দেখতে পাচ্ছে না। দূরের টেবিলে বসা তিনজন লোকের দিকে চোখ গেলো। এরা আবার নতুন করে। কিছু খাবারের অর্ডার দিয়েছে। তিনজনের মধ্যে দু-জনের স্বাস্থ্য বেশ ভালো। মোটাসোটা, দেখেই মনে হয় পেটুক। লোকগুলো চামচ দিয়ে কিছু একটা খাচ্ছে। মুখে থেকে বের করার সময় চামচটা এমনভাবে চেটে চেটে বের করছে যেনো খাবারের সামান্যতম অংশও চামচে রেখে দেবার কোনো ইচ্ছে তাদের নেই। সঙ্গে সঙ্গে নিজের আঙুল চাটা বন্ধ করে দিলো সে। বিব্রতকর একটি অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো চেহারায়। চোখ সরিয়ে নিতেই দেখতে পেলো তার টেবিলের উপর একটি সুপ আর একটি গ্লাস রাখা। একটু চমকে উঠলো। এগুলো কখন রেখে গেলো? অনেকদিন পর গা ছমছম করে উঠলো তার। এখানে ঢোকার আগেই বুঝতে পেরেছিলো জায়গাটা খুবই রহস্যজনক, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে একদম ভুতুরে। কয়েক মুহূর্ত পর্যন্ত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সুপ আর গ্লাসের দিকে। “স্যার?”
চমকে উঠে মুখ তুলে তাকালো। সেই ওয়েটার দাঁড়িয়ে আছে তার ডানপাশে।
“সুপটা খাওয়ার পর একটু বিরতি দিয়ে ড্রিঙ্কসটা নেবেন।”
অবাক হলো সে। এরা দেখি রীতিমতো চাপিয়ে দিচ্ছে কে কোন খাবার খাবে, কখন খাবে! “আমি তো এ দুটো অর্ডার দেই নি…” আস্তে করে বললো।
এই প্রথম মুচকি হাসলো ওয়েটার। “আপনার খাওয়া শেষ..তাই এ দুটো আইটেম নিয়ে এলাম। খেয়ে দেখবেন, অনেক ভালো লাগবে।”
“তোমাদের রেসটুরেন্টে কি সবাইকে এভাবে খাবার দেয়া হয়?”
ছেলেটা কিছু বললো না, অপেক্ষা করলো আরো কিছু শোনার জন্য।
“মনে কিছু করবে না, আমি আসলে সিরিয়াসলিই জানতে চাচ্ছি।”
“স্যার, প্রথমত আমরা এটাকে রেসটুরেন্ট বলি না। অতিথিশালা বলি। এখানকার কোথাও রেসটুরেন্ট শব্দটি পাবেন না আপনি।”
ভুরু কপালে তুললো শহূরে কাস্টমার। “সেজন্যেই না-চাইলেও অনেক আইটেম দেয়া হয়?”
“জি, স্যার,” ওয়েটার হাসিমুখে বললো। “মেহমানদারি না চাইলেও তাকে কিছু দেয়া যায়।”
“কিন্তু আমি কি খেতে চাই সেটা জানতে হবে না?”
“কাস্টমারের অর্ডার দেখে আমরা বাড়তি কিছু দিয়ে দেই। আমরা জানি কোনটার সাথে কি খেলে তৃপ্তি পাওয়া যায়। আর কিছু না বলে ওয়েটার চলে গেলো।
সশব্দে হাফ ছেড়ে সুপের বাটি থেকে এক চামচ সুপ নিয়ে মুখে দিলো। স্বাদের তীব্রতায় দুচোখ বন্ধ হয়ে এলো তার। দারুণ!