রেস্টুরেন্ট হিসেবে জায়গাটা অদ্ভুত। টেবিলে কোনো মেনু নেই। এটাও অদ্ভুত। কোনো ওয়েটারও চোখে পড়ছে না। একেবারেই ব্যতিক্রমী দৃশ্য। আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ভেতরের উত্তর দিকে ছোট্ট একটা দরজা আছে, ওটা দিয়ে হয়তো ভেতরের কোনো ঘরে যাওয়া যায়। দরজার পাশেই রয়েছে ছোট্ট একটা জানালা। গাঢ়-কালচে কাঁচের কারণে ভেতরটা দেখা যাচ্ছে না।
পশ্চিম দিকে ফিরলো। আরো দুটো দরজা আছে। সাইন দেখে বুঝতে পারলো ওগুলো ওয়াশরুম, নারী-পুরুষ দু-জনের জন্যেই। খুট করে শব্দ হতেই চমকে তাকালো সে। তার পেছনে, ঠিক ডানদিকে এক লোক দাঁড়িয়ে। আছে। ওয়েটার হাতে খাবারের মেনু না থাকলে একজন কাস্টমার হিসেবেও ভুল হয়ে যেতে পারতো।
“মেনু দিয়ে গেলাম,” বললো ছেলেটা। “আপনি দেখুন। অর্ডার করার দরকার হলে আমি চলে আসবো।” আর কোনো কথা না বলে চলে গেলো সে।
এই ওয়েটার কিভাবে বুঝবে কখন আমার অর্ডার করার দরকার হবে? ভাবলো সে। আজব। মেনুর দিকে চোখ গেলো। অন্যসব রেসটুরেন্টের মতো আইটেমের বাহূল্য নেই, তবে যে নামগুলো দেখতে পাচ্ছে তার বেশিরভাগই অপরিচিত। সম্ভবত, পরিচিত খাবারগুলোর নতুন করে নামকরণ করেছে এরা। মেনুতে কিছু আইটেম আলাদা করে চিহ্নিত করা আছে মুশকান’স স্পেশাল হিসেবে।
মুশকান’স কারি।
মুশকান’স সিক্রেসি!
মুশকান’স স্যুপ অব লাইফ!
মুশকান’স হাইব্রিড ক্র্যামচপ!
মুশকান’স গোল্ডেন ড্রিঙ্কস!
মুশকান’স জাস্ট টি!
মুশকান জিনিসটা কি? এটা কি কোনো আরবী-পার্সিয়ান খাবারের নাম? যেমন লেবানিজশওয়ার্মা?
সে বুঝতে পারলো এই রেসটুরেন্টটি রহস্য সৃষ্টি করতে, রহস্য বানাতে পারঙ্গম, আর সেটা প্রকাশ করতে একেবারেই অকপট। রহস্য? আমি সেটা ভেদ করতেই এসেছি, মনে মনে বললো সে। মেনু থেকে চোখ সরিয়ে আশেপাশে তাকালো। ওয়েটারের কোনো দেখা নেই। এতো বড় রেসটুরেন্ট অথচ একজনমাত্র ওয়েটার! তাও আবার ভুতের মতো নাজেল হয়, চোখের সামনে থাকে না।
উত্তর দিকে দরজা খুলে সেই ওয়েটারকে বের হয়ে আসতে দেখলো সে। তার কাছে এসে বললো, “জি, স্যার বলেন?”
“আমি লম্বা জার্নি করে এসেছি..পেট ভরে খেতে পারি এরকম কি খাওয়া যেতে পারে? তোমাদের মেনু দেখে তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
ওয়েটারের মুখে কোনো হাসি নেই, বরং কাস্টমারের কথা শুনে কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়েছে মনে হলো। “আপনি ভাত-মাংস কিংবা ফিশ কারি নিতে পারেন, সাথে স্পেশাল কিছু?” “স্পেশাল মানে মুশকান’স জাতীয় কিছু?”।
তার কথার মধ্যে যে শ্লেষ আছে সেটা ওয়েটারকে রুষ্ট করলো। “জি, সেরকমই কিছু।” কাটাকাটাভাবে বললো সে।
“এই মুশকান জিনিসটা কি? অ্যারাবিয়ান নাকি পার্সিয়ান কুইজিন?”
ওয়েটার কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো কাস্টমারের দিকে। “আপনি আমাদের এখানে প্রথমবার এসেছেন, মনে হয়?” “হ্যাঁ।”
সৌজন্যমূলক হাসি দিলো ছেলেটি। “এটা একটা নাম, স্যার।
“কিসের নাম?”
“আমাদের এই রেস্টুরেন্টের মালিকের নাম। উনিই আমাদের সব মেনু তৈরি করেছেন।”
“মেনু তৈরি করেছেন মানে?”
“উনি একজন শেফ…বলতে পারেন, খুবই অসাধারণ একজন শেফ।”
“ও,” মাথা নেড়ে কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিলো কাস্টমার। এরকম প্রত্যন্ত জায়গায় একজন মহিলা রেস্টুরেন্ট চালাচ্ছে, সে নিজে আবার শেফ? অসাধারণ শেফ! “আচ্ছা, ভাতের সাথে তাহলে কি নিতে পারি?” চিন্তা-ভাবনা বাদ দিয়ে খাবারের দিকে মনোযোগ দিলো। তার খিদে অসহ্য পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।
“মুশকান’স কারি নিতে পারেন? বিফ কারি?”
“তাহলে তাই দাও।”
“ওকে, স্যার।”
ওয়েটার আর কিছু না বলে চলে যাচ্ছে দেখে সে অবাকই হলো।
“শোনো?” পেছন থেকে ডাকলো তাকে।
ঘুরে দাঁড়ালো ছেলেটা। “জি?”
“সাথে ডাল কিংবা ভাজি দিলে ভালো হয়..তোমাদের মেনুতে ওরকম কিছু-”
“ডাল আর কয়েক ধরনের ভর্তা পাবেন, স্যার,” তার কথা শেষ করার আগেই ওয়েটার বললো। “ওগুলো আমরা রাইসের সাথে এমনিই দেই, তাই মেনুতে মেনশন করা থাকে না।”
“ও,” ভুরু কপালে তুলে বললো সে। “ঠিক আছে।”
“আপনার যা যা লাগবে বলবেন, সমস্যা নেই।” ওয়েটার সোজা চলে গেলো বন্ধ দরজাটার দিকে।
দূরে বসে থাকা তিনজন কাস্টমারের দিকে তাকালো সে। এরা নিশ্চয় একসঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছে কোথাও। লোকগুলো এমন আয়েশ করে খাচ্ছে, দেখে মনে হচ্ছে দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ খাবারের আস্বাদন করছে তারা। চুপচাপ খাচ্ছে আর একে অন্যের দিকে তাকিয়ে প্রশংসার দৃষ্টিতে ভাব বিনিময় করছে। ব্যাপারটা দেখার মতো। যেমন প্যান্টো মাইম করছে একেকজন! পোশাক আশাক দেখে মনে হচ্ছে বেশ শিক্ষিত আর ধনী, হাতের আঙুল চেটে চেটে খাওয়ার লোক নয় কোনোভাবেই কিন্তু এ মুহূর্তে তাই করছে!
অতো দূর থেকেও ঐ টেবিলের খাবারের সুস্বাদু গন্ধ তার নাকে এসে লাগছে। অদ্ভুত আর সম্মোহনী এক গন্ধ!
উঠে দাঁড়ালো সে। এইমাত্র অর্ডার দিয়েছে, নিশ্চয় খাবার আসতে কমপক্ষে দশ-পনেরো মিনিট লাগবে। ওয়েটারের গদাইলস্করি চালচলন দেখে তার মনে হচ্ছে আরো বেশিও লাগতে পারে। এই ফাঁকে ওয়াশরুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে আসা দরকার।
তাহলে অদ্ভুত এই রেস্টুরেন্টের মালিক একজন মহিলা! ওয়াশরুমের দিকে যাওয়ার সময় মনে মনে বললো সে। এই অপ্রত্যাশিত ব্যাপারটি তাকে আরো বেশি আগ্রহী করে তুললো।