“রাশেদ জুবেরি ধরা পড়ে নি?”
মাথা দোলালেন মাস্টার। “না। আমি ধরা পড়লেও ও পালিয়ে যেতে পেরেছিলো।”
“আপনাকে মিলিটারি ধরার পর কি করলো?”
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বৃদ্ধ। “কী আর করবে..জমিদার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখলো। মারধোর করলো। শেষে মুসলিম হয়ে গেলাম জীবন বাঁচাবার জন্য…ওরা ছেড়ে দিলো আমাকে।”
ছফা আর কিছু বললো না।
“যুদ্ধের বাকি সময়টা এখানেই ছিলাম। পাঁচ-ওয়াক্ত নামাজ পড়তাম, শান্তি কমিটির মিটিংয়ে হাজির থাকতাম…” আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছফার দিকে তাকালেন। “…সেই হিসেবে আমাকেও রাজাকার বলতে পারেন!”
বিবৃত হবার অভিব্যক্তি লুকানোর চেষ্টা করলো ছফা। “রাশেদ জুবেরির এর কোনো খবর পান নি?”
“না। আমি ভেবেছিলাম ও হয়তো মারা গেছে।”
“যুদ্ধ শেষে জানলেন মারা যায় নি?”
“হূম।”
“তারপর?”
“যুদ্ধের পর অলোকনাথের সমস্ত জায়গা-জমি অর্পিতসম্পত্তি হিসেবে নিয়ে নিলো সরকার। বাপ-মা, পরিবার-পরিজন হারিয়ে রাশেদ জুবেরির মানসিক অবস্থা এমন ছিলো যে, সম্পত্তিগুলো ফিরে পাবার কোনো চেষ্টাই করেনি তখন। কয়েক মুহূর্তের সুনসান নীরবতা ভেঙে আবারো বলতে লাগলেন তিনি, “পরে শুনেছি ও এখান থেকে পালিয়ে গিয়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলো। যুদ্ধশেষে ঢাকায়ই থাকতো। বনানীতে ওর বাবার বিরাট একটি বাড়ি ছিলো।”
“ঐ ছেলেটা কি সম্পত্তিগুলো আর উদ্ধার করার চেষ্টা করে নি?”
“কয়েক বছর পর সম্পত্তিগুলো ফেরত পাবার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু সফল হয় নি।”
“সে কি করতো? মানে কাজের কথা বলছি।”
“শুনেছি ব্যবসা করার চেষ্টা করেছিলো, সুবিধা করতে পারে নি। আসলে বাবার সম্পত্তি আর নানার কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রচুর স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করে ঢাকায় বেশ সচ্ছলভাবেই থাকতো সে। সম্ভবত বাড়ি ভাড়ার টাকায় চলতো। মাঝেমধ্যে এখানে আসতো…কয়েকটা দিন আমার এখানে থেকে আবার ঢাকায় চলে যেতো। একটু বাউণডুলে আর অগোছালো ছিলো। সংসার করার দিকে আগ্রহ ছিলো না। খুব বই পড়তো। নেশার মতো বই নিয়ে পড়ে থাকতো সে,” একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, “৯৪ কি ৯৫’র পর দীর্ঘদিন আর এখানে আসে নি। আমার সাথেও যোগাযোগ হয় নি। অনেকদিন পর শুনতে পেলাম ও অসুখে পড়েছে।”
“এটা কোন সালের ঘটনা?”
ছফার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকালেন মাস্টার। “২০০৬ সালের দিকে হবে।”
“উনার কি রোগ হয়েছিলো?”
“ক্যান্সার..প্রোস্টেট ক্যান্সার।”
“উনি কি সুস্থ হতে পেরেছিলেন?”
মাথা দোলালেন বৃদ্ধ। “না।”
“তাহলে মুশকান জুবেরির সাথে
মাস্টার হাত তুলে থামিয়ে দিলেন তাকে। “বলছি। ২০১০ সালের দিকে একটা কাজে ঢাকায় গেছিলাম কয়েকদিনের জন্য, তখন হাসপাতালে গিয়ে ওকে দেখে এসেছিলাম। ভীষণ অসুস্থ ছিলো…দেখাশোনা করার মতো কেউ নেই বলে মাসের পর মাস হাসপাতালেই পড়ে থাকতো।”
|||||||||| “মি. জুবেরি কোন্ হাসপাতালে ছিলেন?” উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলো ছফা।
|||||||||| “অরিয়েন্ট হাসপাতাল।” একটু থেমে ঢোক গিলে নিলেন। “আমি ঢাকা থেকে ফিরে আসার ছয় কি সাত মাস পর মুশান জুবেরি নামের মহিলা এসে হাজির হয় সুন্দরপুরে। নিজেকে রাশেদের স্ত্রী দাবি করে সে।”
মাস্টারকে চুপ থাকতে দেখে ছফা বলে উঠলো, “এ ব্যাপারে কি আপনার মনে কোনো সন্দেহ রয়েছে?”
চোখ পিটপিট করে তাকালেন বৃদ্ধ। “মারাত্মক অসুস্থ, বিছানায় শুয়ে থাকা একজন মানুষ কখন বিয়ে করলো, কিভাবে করলো-এটা ঠিক হিসেবে মেলাতে পারি না। প্রোস্টেট ক্যান্সারের রোগিকে বিয়ে করাটাও বিরল ব্যাপার নয় কি? তাছাড়া যে লোক সুস্থ-সবল অবস্থায় সংসার করার নাম নেয় নি, সে কিনা দুট করে মৃত্যুশয্যায় বিয়ে করে বসলো…স্বীকার করছি, আমি এই বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে সন্দেহ করি এখনও
“উনি যখন এখানে আসেন রাশেদ জুবেরি কি তখনও বেঁচে ছিলেন?”
“না।”
“তাহলে মি. জুবেরি কবে মারা গেছিলেন? আর বিয়েটাই বা করলেন কবে?”
“ভদ্রমহিলা এখানে আসার দু-একমাস আগে জুবেরি মারা যায়…তাদের বিয়েটা কবে হয়েছিলো সেটা আমি জানি না।”
“মুশকান জুবেরি সম্পত্তিগুলো কিভাবে পেয়ে গেলেন? সম্পত্তিগুলো তো রাশেদ জুবেরি উদ্ধারই করতে পারেন নি।”
ছফার দিকে তাকিয়ে রইলেন মাস্টার। “এসব খবর আমার ভালো করে জানা নেই। লোকজন এ নিয়ে নানান ধরণের গালগল্প করে বেড়ায়। কোটা সত্যি কে জানে,” এরপর আতরের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন তিনি, “আপনার সাথে যে আছে ও-ই বরং এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবে।”
ইনফর্মার বিগলিত হাসি দিয়ে ছফাকে আশ্বস্ত করলো। “মাস্টরসাব, ঠিকই কইছেন…এইটা আমি আপনেরে ডিটেইল কমু নে।”
আতরকে কিছু না বলে মাস্টারের দিকে তাকালো নুরে ছফা। “ঐ মহিলা কি রবীন্দ্রনাথের ভক্ত নাকি?…রেস্টুরেন্টের অমন নাম দিয়েছে যে?”
“উনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভক্ত কিনা সেটা আমি বলতে পারবো না তবে আমার মনে হয় নামটার সাথে ভক্ত হবার না-হবার কোনো সম্পর্ক নেই।”
ছফা আগ্রহী হয়ে উঠলো। “ভক্ত না-হলে এমন নাম রাখার কারণটা কি?”
মাস্টার গভীর করে দম নিয়ে নিলেন। “আগেই বলেছি, মহিলা কেন এমন নাম রেখেছেন সেটা আমি জানি না তবে এমন নামে আমি খুব একটা অবাক হই নি।”
নড়েচড়ে বসলো ছফা।
“সত্যি বলতে কি, রবীন্দ্রনাথ আসলেই এখানে কখনও খেতে আসেননি!”