“তারপর?” ছফা মনে করলো শ্রোতা হিসেবে দুয়েকটা প্রশ্ন না করলে কেমন দেখায়।
“বিয়ের কয়েক বছর পর ওদের এক পুত্রসন্তান হয়, সেই ছেলেটার বয়স যখন পনেরো কি ষোলো তখন ঢাকাফেরত এক আত্মীয়ের কাছ থেকে অলোকনাথ বসু জানতে পারলেন তার নাতি দেখতে হুবহু তার মতোই হয়েছে। এই খবরটা শোনার পর থেকে উনার মধ্যে বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেলো। সমস্ত রাগ চলে গেলো, বলতে পারেন। তাছাড়া উনারও বয়স হয়েছিলো…স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে কয়েক বছর আগে…নানা রকম অসুখ-বিসুখে পেয়ে বসেছিলো..কখন কি হয় কে জানে। তো, লোকমারফত মেয়ের কাছে। খবর পাঠালেন স্বামী-সন্তান নিয়ে বাড়িতে চলে আসার জন্য।”
মাস্টার থেমে গেলে ছফা দ্বিধায় পড়ে গেলো কিছু বলবে কিনা। “অঞ্জলি কি এসেছিলো?” অবশেষে বলেই ফেললো সে।
মাথা নেড়ে সায় দিলেন মাস্টার। “স্বামী-সন্তান নিয়েই এসেছিলো। অঞ্জলি কিন্তু এমন সময় এলো যখন দেশের অবস্থা মোটেও ভালো ছিলো না।”
“কখন এসেছিলো ওরা?”
“৭০-এর নির্বাচনের পর পর,” বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বৃদ্ধ। “রাজনৈতিক অবস্থা তখন ভালো ছিলো না। অবশ্য ঢাকায় অনেক কিছু হলেও এই সুন্দরপুরে তেমন খারাপ পরিস্থিতি ছিলো না তখনও। প্রায় মাসখানেক এখানে ছিলো বোধহয়, তারপর আবার ঢাকায় ফিরে যায় কিন্তু এরইমধ্যে অলোকনাথ নিজের সমস্ত সম্পত্তির বিরাট একটি অংশ একমাত্র নাতির নামে উইল করে দেন, বাকি সম্পত্তি উনি দেবোত্তর করে দিয়েছিলেন।”
“তার সম্পত্তির পরিমাণ কেমন ছিলো?”
ছফার দিকে এমনভাবে তাকালেন মাস্টার যেনো সে এক যৌতুকলোভী পাত্র, শুধুমাত্র বিরাট সম্পত্তির গন্ধ পেয়ে ছুটে এসেছে এই সুন্দরপুরে! “জমিদার হিসেবে অনেক সম্পত্তির মালিকই ছিলো কিনতু আস্তে আস্তে সেগুলো কমতে শুরু করে। তারপরও নাতির নামে যখন লিখে দিয়ে যান তখনও বেশ ভালো কিছু জায়গা-জমি আর স্বর্ণালঙ্কার ছিলো।”
ছফা চুপ মেরে রইলো।
“শুনেছি স্বর্ণালঙ্করগুলোর সবই নাতিকে দিয়েছিলেন, আর সম্পত্তির বেশিরভাগ৷”
“তারপর উনার নাতি কী করলেন এগুলো পেয়ে?”
“ঐ সময় অলোকনাথ বসুর নাতির বয়স ছিলো খুব কম, মাত্র সাবালক হয়েছে। তাছাড়া উইল করার কয়েক মাসের মধ্যেই স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।” মাস্টার চুপ মেরে গেলেন। এবার দীর্ঘ সময়ের জন্য।
ছফা কিছু বললো না, অপেক্ষায় থাকলো মাস্টারের মুখ খোলার জন্য।
আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সুন্দরপুরের প্রবীণ শিক্ষক। “পঁচিশে মার্চের পর অঞ্জলি তার স্বামী-সন্তান নিয়ে এখানে বাবার কাছে চলে আসে আবার।” একটু কেশে নিলেন বৃদ্ধ। “এপ্রিলের শুরুতে পাকিস্তানি মিলিটারি সুন্দরপুরে আসে..অলোকনাথ, অঞ্জলি, সাঈদ জুবেরিসহ তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করে।”
মাস্টারের চোখেমুখে বিষাদের ছায়া।
“উনারা ঐ সময় এখানেই ছিলেন? মানে সবাই?”
“শুধু রাশেদ জুবেরি বাদে।”
“রাশেদ জুবেরি?”
“অঞ্জলির ছেলে।”
“ও তখন কোথায় ছিলো?”
প্রবীণ লোকটি ছফার দিকে তাকালেন। চেহারায় বিষাদের ছায়া। প্রায় অস্ফুটস্বরে বললেন, “আমার এই বাড়িতে!”
“আপনার বাড়িতে?”।
মাথা নেড়ে সায় দিলেন মাস্টার। “হুম। মিলিটারি হামলা চালাবার ঠিক আগে দিয়ে রাশেদ জুবেরি আমার সাথেই ছিলো। আমার কাছে এসেছিলো কিছু বই ধার নিতে। ছেলেটা খুব বই পড়তো। সুন্দরপুরে তো কোনো বইয়ের দোকান ছিলো না তখন…লাইব্রেরিও ছিলো না…অবশ্য এখনও নেই…” চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললেন, “ওর মা অঞ্জলিই বলেছিলো আমার কাছে প্রচুর বই আছে৷ সে জানতো আমি বই-টই পড়ি।”
“আপনার কাছে বই ধার নিতে এসে বেঁচে গেলো রাশেদ জুবেরি?”
“তা বলতে পারেন।”
আর কোনো প্রশ্ন না করে চুপ মেরে গেলো ছফা।
“পাকিস্তানি মিলিটারি সবাইকে খুন করে লাশগুলো জমিদার বাড়ির জোড়-পুকুরে ফেলে দেয়। পরে মিলিটারি জমিদার বাড়িটা দখল করে ওখানে ক্যাম্প বানায়…” মাস্টার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ঐ ক্যাম্পে অনেককে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছিলো,” ভদ্রলোক যেনো উদাস হয়ে গেলেন।
অনেকক্ষণ চুপ থেকে আতর আলী উসখুশ করতে শুরু করলো, কিন্তু তাকেশান্ত থাকার ইশারা করলো ছফা।
“এখানকার বদরবাহিনীর কিছু মেম্বার আমাদের গ্রামের অনেক হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করে…এরমধ্যে আমার অনেক আত্মীয়ও ছিলো।” মাস্টারের চোখ দুটো কেমন ঘোলা হয়ে গেলো। “আমাকেও করেছিলো..”।
ছফা কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বললো, “রাশেদ জুবেরি, তার কি হলো?”
দীর্ঘশ্বাসের সাথেই বললেন মাস্টার, “যখন জানতে পারলাম মিলিটারি ওর পরিবারের সবাইকে হত্যা করেছে তখন আমি ওকে নিয়ে নিরাপদ কোথাও পালানোর চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু তখন পুরো গ্রাম ঘিরে রেখেছিলো মিলিটারি আর তাদের দোসররা। ওরা এই বাড়িতেও হানা দেয়। উপায় না দেখে বড় কবরস্তানে গিয়ে লুকাই আমরা।”
কবরস্তানের কথা শুনে ছফার মনে পড়ে গেলো একটু আগে সে কবরে পড়ে গেছিলো।
“একটা পুরনো কবর…শেয়াল-কুকুর হয়তো গর্ত করে রেখেছিলো…আমরা দু-জন ওটার মধ্যে ছিলাম সারাটা রাত।”
একটু আগে কবরে পতিত হবার ব্যাপারটা মামুলি হয়ে গেলো এ কথা শুনে। “তারপর?”
“পরদিন খুব ভোরে রাশেদকে নিয়ে আমি সুন্দরপুরের বাইরে যাবার চেষ্টা করলে মিলিটারির কাছে ধরা পড়ে যাই।”