“খাড়ায়া আছেন ক্যান? আহেন,” পেছন ফিরে তাড়া দিয়ে বললো ইনফর্মার।
ঘরের সামনে ছাউনি দেয়া বারান্দায় একটা কাঠের বেঞ্চি আর দুটো চেয়ার আছে। দেখে মনে হচ্ছে কমপক্ষে ত্রিশ-চল্লিশ বছরের পুরনো। একটা চেয়ারে বসে পড়লেন মাস্টার, আতর আলী বসলো বেঞ্চিটাতে। ছফা এগিয়ে গিয়ে চুপচাপ অন্য চেয়ারটাতে বসে পড়লো।
“মাস্টরসাব, উনি ঢাকা থেইকা আইছেন…উনার নাম নুরে ছফা।”
মাস্টারের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে সালাম ঠকলো ছফা।
“এই গ্রামে উনার বিয়ার সম্বন্ধ হইছে, মাইয়ার ব্যাপারে খোঁজ নিবার চাইতাছেন…” আতর সময় নষ্ট না করে তার বানোয়াট কথাবার্তা বলে যেতে লাগলো। “…আমাগো ওসিসাব কইলো আপনের কাছেনিয়া যাইতে…”
নুরে ছফা মনে মনে হাসলো। ইনফর্মারদের এই এক স্বভাব, সব কিছুতে থানা-পুলিশের রেফারেন্স দেবে।
আতরের কথা আমলে না নিয়েই মাস্টার মুখ তুলে তাকালেন ছফার দিকে। তার মুখের অভিব্যক্তি বিভ্রান্তিকর। সেটা দেখে বোঝার উপায় নেই লোকটা কী ভাবছে।
“এই গ্রামে আপনের মতো শিককিত আর জ্ঞানী মানুষ একজনও নাই। এইখানকার সব মানুষের চৌদ্দগুষ্টির খবর আপনে জানেন। তার চায়াও বড় কথা, আপনে মানুষ ভালা। মিছা কথা-”।
হাত তুলে আতরকে থামিয়ে দিলেন মাস্টার। “পাত্রিটা কে? আমি কি ওকে চিনি? আমার কোনো ছাত্রি?”
আতর কোনো রকম লুকোছাপা না করেই ছফাকে চোখ টিপে মুচকি হাসি দিলো। চশমাহীন মাস্টারের ঝাপসা দৃষ্টির সুবিধা নিলো সে। “না, না। আপনের ছাত্রি না। ঐ যে…হোটেলওয়ালি..মুছকান,” ভুল উচ্চারণে নামটা বললো আতর। “মুছকান জুবুরি।”
ভুরু কুচকে ফেললেন মাস্টার। “উনি পাত্রি!”
সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো সে। ইনফর্মারের ইশারা পেয়ে বললো, “জি…উনিই.”
ছফার দিকে ভালো করে তাকালেন মাস্টার। চোখ দুটো পিটপিট করে দেখার চেষ্টা করছেন। বোঝাই যাচ্ছে চশমা ছাড়া দেখতে পাচ্ছেন না ভালো করে। “ও,” আর কিছু বললেন না সুন্দরপুরের বৃদ্ধ মাস্টার।
“মাস্টরসাব, ভাইজান ঐ বেটির সমন্ধে কিছু জানবার চায়,” বিগলিত হাসি দিয়ে বললো আতর। “বুঝেনই তো, বিয়া-শাদীর ব্যাপার…”
অসম্ভষ্ট দেখালো মাস্টারকে। “বেটি, মাথারি এইসব শব্দ আমার সামনে বলবে না…ভদ্রমহিলা বলো।”
জিভে কামড় দিয়ে চোখ টিপে বললো ইনফর্মার, “মুককু-সুকু মানুষ…ভুল হইয়া গেছে, মাগুরসাব।”
একান্ত অনিচ্ছায় ছফার দিকে তাকিয়ে বললেন বৃদ্ধ, “আমি তো উনার সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানি না।”
“ওর ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডটা…” নুরে ছফা বললো। “…মানে আমি জানতে পেরেছি ও এই এলাকার নয়…তাহলে এখানে কিভাবে এলো?”
পিটপিট করে চেয়ে রইলেন বৃদ্ধ। “আপনার সাথে উনার পরিচয় হয়েছে কিভাবে?”
একটু ধন্দে পড়ে গেলো ছফা, তবে সেটা কাটিয়ে উঠতে বেশি সময়ও লাগলো না। “ইয়ে, মানে…ফেসবুকে।”
মাস্টার এবং আতর দু-জনেই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। এই জিনিসের নাম এর আগে তারা কেউ শুনেছে বলে মনে হলো না।
“কি বুক বললেন?”
“ফেসবুক।”
মাস্টার একটু ভেবে নিলেন। “এটা কি পত্রমিতালীর মতো কিছু? আগে চিঠির মাধ্যমে বন্ধুত্ব করার জন্য এক ধরণের চটি বই বের করা হতো…এখন আর ওসব দেখা যায় না।”
ছফা মুচকি হাসলো। পত্রমিতালী সম্পর্কে তার ভালোই ধারণা আছে। ছোটোবেলায় সেও এরকম বন্ধুত্ব করেছে গ্রামে বসে। ঢাকাসহ বড় বড় কয়েকটি শহরে তার কিছু পত্রমিতালী বনধু ছিলো, বলা বাহুল্য, তারা সবাই ছিলো মেয়ে! এ-সময়কার ফেসবুক যে আসলে পত্রমিতালীরই একটি ডিজিটাল সংস্করণ সেটা এর আগে কখনও মনেই হয় নি। প্রথমে ই-মেইল, সেলফোন এসে চিঠি-পত্র হটিয়ে দিলো, তারপর ফেসবুক এসে বিতারিত করলো পত্রমিতালীকে।
“অনেকটা সে-রকমই,” বললো সে।
“ও,” মাস্টার আস্তে করে বললেন। “সেজন্যেই তেমন কিছু জানেন। না।”
কিছু বললো না ছফা।
“ভদ্রমহিলা অলোকনাথ বসুর নাতবৌ,” কথাটা বলেই উদাস হয়ে গেলেন তিনি। যেনো অতীতে ফিরে যাবার চেষ্টা করছেন।
ছফা আর আতর উদগ্রীব শ্রোতা হয়ে বসে রইলো।
“অলোকনাথ বসু ছিলেন সুন্দরপুরের সবচাইতে প্রভাবশালী পরিবারের শেষপ্রজন্ম,” গভীর করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অবশেষে বলতে শুরু করলেন আবার। “কয়েক পুরুষ ধরে তারা জমিদার ছিলেন।”
“অলোকনাথ বসুর নাতবৌ মুশকান জুবেরি হয় কি করে?”
ছফার দিকে তাকালেন মাস্টার। “আপনার প্রশ্নটা একদম সঙ্গত। যেকোনো কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ এ প্রশ্ন করবে। এর পেছনে একটা গল্প আছে।”
“কি গল্প?”
“অলোকনাথ বসুর একটাই সন্তান ছিলো, অঞ্জলি বসু। উনি অনেক চেষ্টা করেছেন পুত্রসন্তানের জন্য, দ্বিতীয়বার বিয়েও করেছিলেন কিনতু লাভ হয় নি। ও ঘরে কোনো সন্তানই জন্মায় নি। যাইহোক, মেয়েটা একটু বড় হবার পর পুত্রসন্তানের ইচ্ছে পরিত্যাগ করেন তিনি, মেয়েকে ভালোভাবে লালন-পালন করার দিকেই মনোযোগ দেন।” একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন, “অঞ্জলিকে ঢাকায় পাঠানো হয় পড়াশোনার জন্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় সে, ওখানেই তার সাথে সাঈদ জুবেরির পরিচয় হয়। তারা দুজনেই ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছিলো। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়ার অপরাধে জেলও খেটেছে। অলোকনাথ বসু তার মেয়ের এই সম্পর্কের ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেন নি। তার জন্য ব্যাপারটা ছিলো হৃদয়বিদারক। পুত্রসন্তানের আশা বাদ দিয়ে মেয়েকে ঘিরেই ভবিষ্যৎ বংশধরের স্বপ্ন দেখছিলেন, আর সেই মেয়ে কিনা বিয়ে করতে চায় মুসলিম ছেলেকে…” আবারো থেমে দম নিয়ে নিলেন মাস্টার। “যাইহোক, পিতার অমতে অঞ্জলি বিয়ে করে বসে জুবেরিকে। এটা সম্ভবত ভাষা আন্দোলনের দু-এক বছর পরের ঘটনা। এরপর দীর্ঘদিন মেয়ের সাথে যোগাযোগ রাখেন। নি অলোকনাথ।”