“পোলাটা কেমতে জানি জাইনা যায় গেরামে কেউ মরবো…মরার আগেই অ্যাডভান্স কব্বর রেডি কইরা রাখে।”
শালার অ্যাডভান্স কবর! মনে মনে বললো ছফা। এইসব তারছেঁড়া লোকজনের ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ নেই। সে নিশ্চিত, এই ফালু লোকটি চতুর জ্যোতিষী, ভণ্ডপীর আর সাধুবাবাদের মতোই কেউ হবে। নিজের চাতুর্য আর গ্রামের মানুষজনের বিশ্বাসের দুর্বলতাই যাদের একমাত্র সম্বল।
“ওর অ্যাডভান্স কব্বর খুদার কথা শুনলে গেরামের বুড়া-বুড়িগো বুকপুকানি শুরু হইয়া যায়। আর যে ব্যাটা-বেটি বিমার হইয়া বিছানায় পইড়া আছে ওর তো পাতলা পায়খানা শুরু হইয়া যায়। বার বার খালি দরজার দিকে তাকায় দেখে আজরাইল আইলো কিনা!”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো ছফা। এসব কথাবার্তায় বিরক্ত হয়ে উঠছে সে।
“এহন পর্যন্ত ফালুর অ্যাডভান্স কব্বর মিস হয় নাই!” প্রশংসার সুরে বললো আতর।
জীবিত অবস্থায় কবরে পতিত হবার বিচ্ছিরি অভিজ্ঞতা লাভ করার পর এসব গাঁজাখুড়ি গল্প শুনতে ইচ্ছে করছে না। ফালুর শতভাগ রেকর্ড অক্ষুণ্ণ থাকবে কি থাকবে না সেটা নিয়েও তার কোনো মাথাব্যথা নেই।
“তয় আইজ মনে হয় মিস্ হইবো। রাইত তো মেলা হইছে, এহনও কুনো মরার খবর নাই!”
“আর কত দূর?” অধৈর্য হয়ে জানতে চাইলে ছফা। ফালুসংক্রান্ত আলাপ থেকে তাদের গন্তব্যের দিকে মনোযোগ ফেরাতে চাইছে।
“ওই তো মাস্টরের ভিটা দেহা যাইতাছে…হারিকেন জ্বলছে ঘরে।”
একটু দূরে মিটমিট করে লালচে আলো জ্বলতে দেখলো সে। “আমি খালের কথা বলছি, হাত-পা ধুতে হবে।”
“ও,” ইনফর্মার বললো, “ওইটা মাস্টরের ভিটার এটটু আগেই..”
ছফা আর কথা বাড়ালো না, জোরে জোরে পা চালালো।
“…এই তো, সামনেই…”
*
আতর আর ছফা যখন কবরস্তান থেকে বের হয়ে যাচ্ছে তখন তাদের অলক্ষ্যে, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে আবছায়া এক মূর্তি মুখে গামছা। পেচিয়ে বড়সড় জারুল গাছের আড়াল থেকে চুপচাপ দেখে যাচ্ছে। দু-জন মানুষের অবয়ব মিইয়ে গেলে গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে এলো সে। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলো সিদ্ধান্তহীনতায় তারপর এগিয়ে গেলো খোলা কবরের দিকে।
২. বিস্তৃত ক্ষেতের মধ্যে
অধ্যায় ৬
আশেপাশে বিস্তৃত ক্ষেতের মধ্যে উঁচু একটি ভিটে চাঁদের মলিন আলোতেও উদ্ভাসিত। বড়বড় জানা-অজানা বৃক্ষ যেনো হাতে হাত ধরে চারপাশ ঘিরে প্রাচীর বানিয়ে রেখেছে। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রাচীর ভেদ করে টিমটিমে লালচে আলোর একটি বিন্দু জ্বলছে।
একটা সরু খালের পানিতে যতোটুকু সম্ভব হাত-পা-মুখ ধুতে ধুতে সেই ভিটের দিকে তাকালো ছফা। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আতর। আয়েশ করে সিগারেটে টান দিচ্ছে।
হাত-মুখ ধুয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। শার্টের একপাশে কিছুটা কাদা লেগেছে, ওগুলোর ব্যাপারে আপাতত কিছু করার নেই। পকেট থেকে রুমাল বের করে কিছুটা কাদা মুছে আতর আলীকে সাথে নিয়ে নিঃশব্দে কিছুটা পথ সামনে এগিয়ে গেলো। ভিটার কাছে আসতেই বোঝা গেলো একটা টিনের ঘরের জানালা দিয়ে হারিকেনের আলো দেখা যাচ্ছে।
মাটি কেটে তৈরি করা তিন-চারটা ধাপ পেরিয়ে উঁচ ভিটায় উঠেই হাঁক দিলো আতর, “মাস্টরসাব…ঘুমায় গেছেন নি? ও মাগুরসাব?”।
কয়েক মুহূর্ত পরই দরজা খুলে হাতে হ্যারিকেন নিয়ে বয়স্ক এক লোক বের হয়ে এলেন। “কে? এতো রাতে কে ডাকে?”
ভদ্রলোকের বাচনভঙ্গি স্পষ্ট এবং প্রমিত। ছফা কিছুটা অবাকই হলো। যে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকও প্রমিত-বাঙলায় কথা বলতে পারে। না সেখানে সুন্দরপুরের প্রাইমারি-স্কুলের শিক্ষকের কাছ থেকে এরকমটি সে আশা করে নি।
“আমি আতর,” নিজের নামটা সুন্দর করেই বললো ইনফর্মার। “ঢাকা থেইকা একজন মেহমান আইছে…”
গায়ে শাল জড়ানো এক বৃদ্ধ; মাথায় কানটুপি; মুখে গোঁফ আর লম্বা। দাড়ি; সবটাই সাদা ধবধবে; অবশ্য চোখে কোনো চশমা নেই।
“আমার সাথে দেখা করতে এসেছে?” বৃদ্ধের চোখেমুখে জিজ্ঞাসা। চোখ কুচকে দেখার চেষ্টা করলেন তিনি।
“আপনের চশমা কই, মাস্টরসাব?”
আতরের প্রশ্নে বৃদ্ধের চোখমুখ আরো কুচকে গেলো। “আর বোলো না, ঢাকা থেকে ফেরার সময় বাসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তখনই ব্যাগটা চুরি হয়ে যায়। চশমাটা ওটার ভেতরেই ছিলো।”
“ক কি?” কৃত্রিম আফসোস আতরের কণ্ঠে। “দ্যাশটা এক্কেবারে চোর বাটপারে ভইরা গ্যাছে।”
কথাটা শোনার পর বৃদ্ধের মুখে প্রচ্ছন্ন বাঁকাহাসি ফুটে উঠলো।
ছফা জানে পুলিশের ইনফর্মারদের কেউই পছন্দ করে না, তবে তাদেরকে ভয় পায়, তাই মুখ ফুটে কেউ কিছু বলার সাহস রাখে না।
চারপাশে তাকালো সে। উঁচু ভিটের উপরে একটি বসতবাড়ি। হালকা কুয়াশায় পৌণে একখান চাঁদের আলোয় শুধু দেখা যাচ্ছে সেই ভিটার চারপাশে বড়-বড় গাছের সমাহার। দুটো ছোটো-ছোটো টিনশেডের ঘর ছাড়া আর কিছু নেই। ঘর দুটোর বিপরীতে, মাঝখানের বিশাল আর পরিস্কার উঠোনের পর বাঁশ-কাঠ দিয়ে বানানো একটি টয়লেট। বাড়ির চারপাশে বড়বড় গাছ ছাড়া ঝোঁপঝাঁড়ও রয়েছে প্রচুর। যেনো সুরক্ষিত প্রাচীর ওগুলো। ঝিঁঝি পোকা ডেকে যাচ্ছে বেশ জোরে জোরে।
মাস্টার ঘরের সামনে উঠানের দিকে যেতে থাকলে আর তার পেছন পেছন মিনতির সুরে কী যেনো বলতে বলতে এগিয়ে গেলো। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলো ছফা, সে বুঝতে পারছে না কী করবে।