স্বাদ পুরোপুরি জিভের উপর নির্ভরশীল। শব্দ নির্ভর করে কানের উপরে। দৃষ্টির নির্ভরতা চোখেতে। একদিক থেকে দেখলে স্বাদের ব্যাপারটা বেশ নিশ্চিত। টক-ঝাল-মিষ্টি-নোনতা-তেতো-এসব স্বাদের পার্থক্য বোঝাটাও খুব কঠিন কিছু নয়। পাঁচটি স্বাদের মধ্যে বেশ ভিন্নতার কারণে আলাদা। করতে খুব একটা অসুবিধাও হয় না।
একটি স্বাদকে আরেকটির সাথে মিশিয়ে তৈরি করা যায় নতুন স্বাদ। মিষ্টির সাথে মিষ্টি। এটা ভারসাম্য তৈরি করে। কিন্তু প্রকৃতিতে শুধু ভারসাম্য আর সাযুজ্যই মেলে না, বৈপরীত্যও দেখা যায়। দেখা যায় ভিন্নতা। ডিজাইনাররা একে বলে কন্ট্রাস্ট। ভারসাম্যের ঠিক উল্টো। কিংবা আদৌ ভারসাম্যপূর্ণ নয়। টকের সাথে ঝাল। ঝালের সাথে মিষ্টি! টকের সাথে মিষ্টি। মিষ্টির সাথে নোনতা! নোনতার সাথে ঝাল! সবই সম্ভব। শুধু দরকার সীমাটুকু বোঝা। ঝালের রয়েছে নির্দিষ্ট সীমা। মিষ্টি, টক, নোনতা সবকিছুরই সীমানা আছে। কে কার সীমানায় কতোটুকু অনুপ্রবেশ করবে সেই পরিমিতবোধ থাকতে হবে, নইলে বিপর্যয়।
এই বিপর্যয় উভয়ের জন্যেই!
আজ হঠাৎ করেই একজন সীমানা লঙ্ঘন করেছে। তাকে অসহায় আর দুর্বল এক নারী ভেবেছে। মনে করছে তার সাথে যা-ইচ্ছে তাই করা যাবে। লোকটার ধারণাই নেই সে কতো বড় ভুল করেছে। তবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে না। দুশ্চিন্তা করার মতো নার্ভ বস্তুকাল আগে এক অবিশ্বাস্য ঘটনার পর হারিয়ে ফেলেছে সে।
আরেকটু চুমুক দিয়ে পাশের টেবিলে রেখে দিলো গ্লাসটা। বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে।
বিপদের সবটুকু, বিপর্যয়ের সবটুকু সীমা লঙ্ঘনকারীর জন্যেই বরাদ্দ!
*
“হায় হায়!” গর্তের উপর থেকে আতর আলীর কণ্ঠটা শুনতে পেলো ছফা।
“কব্বরে পইড়া গেছেন দেহি!”
কথাটা শুনে তার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেলো। কবরে! নরম আর ভেঁজা মাটির সাথে তার গালে আর দু-হাতে লেগে আছে কঙ্কালের মতো কিছু। সারা শরীর গুলিয়ে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে। আমি কি পচা-গলা লাশের উপরে পড়ে আছি? সঙ্গে সঙ্গে ধরফর করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই টের পেলো আতর আলী তার ডানকাঁধে হাত রেখেছে।
“ভাইজান, আমার হাতটা ধরেন…জলদি উইঠ্যা আসেন।”
ইনফর্মারের হাতটা শক্ত করে ধরলো সে। গর্ত থেকে উঠে আসার পর বুঝতে পারলো শরীরে কিছু কাদা লেপ্টে আছে।
“চোট পান নাই তো?”
“না।” দাঁতে দাঁত পিষে বললো ছফা। “এ-এক্ষুণি ধুতে হবে এগুলো!” গায়ের কাদাগুলো দেখিয়ে বললো। কবরস্তানের কাদা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কথা চিন্তাও করতে পারছে না।
“আসেন,” আতর তার হাতটা ছেড়ে দিয়ে বললো। “সামনেই একটা খাল আছে.. ধুইয়া নিয়েন।”
রাগেক্ষোভে সারা শরীর কাঁপছে তার কিন্তু মুখে কিছু বললো না। এই ব্যাটা ইনফর্মার শর্ট-কাট মারতে গিয়ে কবরস্তানের ভেতর দিয়ে না এলে এভাবে কবরে গিয়ে পড়তে না আজ। “ও-ওখানে কঙ্কাল আছে মনে হলো!” খোলা কবরের দিকে ইঙ্গিত করে বললো সে।
“আরে না। ওইটা তো নতুন কব্বর…ঐ দেহেন,” জবাব দিলো। ইনফর্মার। কবরের একপাশে আলগা মাটির স্তূপ দেখালো হাত দিয়ে।
হাফ ছেড়ে বাচলো ছফা। সম্ভবত আতঙ্কের কারণে সে মনে করেছে কবরের ভেতরে কঙ্কাল রয়েছে। ওগুলো হয়তো গাছের ডালপালাও হতে পারে, কিংবা অন্য কিছু। এমন সময় গাছের পাতা নড়ার শব্দে চমকে উঠলো সে। শব্দটার উৎসের দিকে তাকালো। তাদের থেকে দশহাত দূরে একটা বড় গাছ। ডাল-পালা ছড়িয়ে আছে মাথার উপরে। গাছটার চারপাশে কবরের সারি।
“কে ওখানে?” গাছটা দেখিয়ে বললো।
“ওইখানে আবার কে?” বুঝতে না পেরে বললো আতর।
“আপনি কিছু শুনতে পান নি? আমার তো মনে হচ্ছে গাছের আড়ালে কেউ আছে।”
আতর চোখ কুচকে তাকালো সেদিকে। অন্ধকারে অবশ্য বেশি কিছু দেখারও নেই। “আরে না,” অবশেষে বললো সে। “কবরস্তানে আইলে সতেরই এমন মনে হয়। এইটা হইলো মনের ভুল।”
আক্ষেপে মাথা দোলালো ছফা। আসলেই তার মনের ভুল কিনা বুঝতে পারছে না।
“কবরস্তানে আত্ম-ফাত্মা কিছু থাকে না..থাকে বাঘডাশ, শিয়াল এইসব জানোয়ার।” একটু থেমে আবার বললো, “আহেন…সামনে আগাই
ছফাও চাইছে এই কবরস্তান থেকে যতো দ্রুত সম্ভব বের হয়ে যেতে। ইনফর্মারের পাশাপাশি আবার হাঁটতে শুরু করলো সে।
“ফালু পোলাটা আজিব কিসিমের, বুঝলেন?” হাঁটতে হাঁটতে বললো ইনফর্মার। “হালারপুতে অ্যাডভান্স কব্বর খুইদা রাখে।”
অ্যাডভান্স কবর খুরে রাখে মানে! অবাক হলো ছফা। “ফালু কে?”
“ফালু এই কবরস্তানের গোর খুদে।” বলতে শুরু করলো ইনফর্মার। “পোলাটার বেরেইনে এটু পবলেম আছে।”
ফালু কিংবা খালু, কারোর ব্যাপারেই তার কৌতূহল নেই। যত্তসব ফালতু লোকজন। হাতে-পায়ে লেগে থাকা কাদাগুলোর জন্য সারা শরীর গুলিয়ে উঠছে। লম্বা লম্বা পা ফেলে আতর আলীর পাশে চলে আসার সময় অন্ধকারে খেয়াল করেনি সরু রাস্তার পাশে সদ্য খোরা একটি কবর ছিলো। সেই খোলা কবরে বাম পা-টা পড়তেই ভারসাম্য ধরে রাখতে পারে নি।
“সুন্দরপুরের অনেকে মনে করে ফালু খুব কামেল লোক। তারে খুব মাইন্য-গইন্যও করে। বাড়িতে কেউ বিমারে পড়লে ওরে নিয়া গিয়া ভালমন্দ খাওয়ায়…যেন ফালু তাগোর রুগির লাইগা অ্যাডভান্স কব্বর না খুদে। এইটারে আপনে ঘুষও কইবার পারেন।”
ছফা তু-হা কিছুই করলো না। সে জানে প্রতিটি গ্রামেই এরকম কিছু কামেল লোকজন থাকে। অর্ধেক গ্রাম তাকে মানে, বাকি অর্ধেক তার ব্যাপারে আধো-অবজ্ঞা আর সন্দেহ পোষণ করে। এদেরকে ঘিরে এক একটি কিংবদন্তী ঘুরে বেড়ায় গ্রামের চৌহদ্দির মধ্যেই। বড়জোর আশেপাশের কয়েকটি গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে সেটা। তারপর কামেলদের কেরামতি আর দৌড়ায় না! এ দেশে কেরামতিগুণসম্পন্ন বাবা হওয়াটা খুব সহজ। একজন মস্তিষ্কবিকৃত মানুষও উদ্দেশ্যবিহীনভাবে হাটা-হাটি করে বাবা হয়ে যেতে পারে!