“আপনার ছেলে আছে?”
আতর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। “আছিলো…” কথাটা বললো মলিন কণ্ঠে।
ছফা ইচ্ছে করেই চুপ মেরে রইলো, সে অন্য কিছুর গন্ধ পাচ্ছে। এ মুহূর্তে ব্যক্তিগত প্যাচাল শুরু করার কোনো ইচ্ছে তার নেই।
“এহনও আছে,” আপন মনেই বলতে লাগলো সামনের লোকটি, “তয় আমার লগে কুনো কানেকশন নাই। ওর মার লগে থাকে, কলেজে পড়ে।”
“ও,” ছোট্ট করে বললো ছফা।
“দেইখেন..গর্ত আছে।”
আতরের সতর্কবাণী শুনে একটু থমকে দাঁড়িয়ে মোবাইলফোনের ডিসপ্লের আলো ফেললো। গর্তটা লাফিয়ে ডিঙলো সে।
গ্রামের মেঠোপথ যেমন হয়, আঁকাবাঁকা হয়ে পথটি চলে গেছে কতোদুর সেটা এই আবছা-অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না, তবে চারপাশে ঝোঁপঝাঁড় দেখে মনে হচ্ছে না এটা কোনো লোকালয়। ছফা কোনো প্রশ্ন না করে চুপচাপ অনুসরণ করে গেলো আতর আলীকে। দুজনের পদক্ষেপের শব্দ ছাড়া আর কিছু নেই। জনমানবহীন এলাকাটি রাতের অন্ধকারে ভৌতিক আবহ সৃষ্টি করেছে। ছফা নিশ্চিত, একা একা এরকম জায়গা দিয়ে শহরে বড় হওয়া মানুষ হেঁটে যেতে পারবে না, গা ছমছম করে উঠবে। তবে তার মধ্যে এ নিয়ে কোনো ভয়ডর নেই। পুরোটা কৈশোর গ্রামেই কাটিয়েছে। তাছাড়া ভূতে বিশ্বাস করে না সে। গড়পরতা মানুষের চেয়ে তার সাহসও একটু বেশি।
“ধ্যাত!” বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো ছফা।
আতর থমকে দাঁড়ালো। “কি হইছে?”
“মোবাইলের চার্জ শেষ।” তার ফোনটা অফ হয়ে গেছে।
ইনফর্মার আবার হাঁটতে শুরু করলো। অনেকটা বিড়বিড় করেই বলতে লাগলো, “শহরের মানুষ তো…রাইত-বিরাইতে গাও-গেরামে চলাফেরা করার অভ্যাস নাই।
মুচকি হেসে ফোনটা পকেটে রেখে দিলো ছফা। অন্ধকারেই টের পেলো ঢালু একটি জায়গা দিয়ে আস্তে আস্তে উপরে উঠে যাচ্ছে।
“শটকাটে যাইতাছি আর বেশিক্ষণ লাগবো না।”
আতর আলীর কথায় কোনো জবাব দিলো না সে। লোকটা থেকে মাত্র দু-তিনহাত পেছনে আছে। অন্ধকারেই টের পেলো চারপাশের ঝোঁপঝাঁড় একটু বদলে গেছে। জায়গাটা কেমন জানি। একটা গন্ধ নাকে আসছে। সুগন্ধী কিছু। তবে এর সাথে মিশে আছে বাজে একটা গন্ধও। সব মিলিয়ে অশরীরি এক আবহ ফুটে উঠছে আস্তে আস্তে।
“গন্ধটা কিসের?” খুব স্বাভাবিক কণ্ঠেই জানতে চাইলো সে।
“আগরবাত্তির,” পথ চলতে চলতে বললো আতর।
“এইটা আমাগো বড় কবরস্তান…এইটার ভিতর দিয়া গেলে শটকাটে যাওন যায়।”
কবরস্তান শুনে ছফার গা ছমছম করে উঠলো। এই ইনফর্মার তাকে এরকম রাতের বেলায় কবরস্তানের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে লোকটার সাহস আছে কিন্তু ভব্যতাজ্ঞান নেই।
জায়গাটা কবরস্তান শোনার পর থেকে আপনাআপনি তার চোখ চলে যাচ্ছে আশেপাশে, এটা কোনোভাবে এড়াতে পারছে না। এখন আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছে ছোটো ছোটো ঢিবির মতো মাটির স্তূপগুলো ওগুলোর নীচে শায়িত আছে মৃতেরা।
“রাইতে নতুন কুনো কব্বর দিছে মনে হয়,” আতর বললো, “মুরদার লোকেরা আগরবাত্তি জ্বালায়া গেছে।”
ছফা কিছু বললো না। ভুতের ভয় না থাকুক, কবরস্তান দিয়ে রাতের বেলায় হেঁটে যাওয়াটা মোটেও স্বস্তির ব্যাপার নয়। আতর আলীর উপর রাগ করেই জোরে জোরে পা চালাতে লাগলো সে। এখান থেকে যতো দ্রুত বের হওয়া যায় ততোই স্বস্তির ব্যাপার।
“ঐ লোকের নাম কি?” জোরে জোরে পা চালিয়ে আতরের ঠিক পাশে এসে বললো সে।
“নাম তো একখান মাশাল্লা..কী আর কমু…উল্টাইলেও যা সোজা করলেও তা!”
“কি বল-” বিস্মিত ছফা কথাটা শেষ করতে পারলো না, “আ-আ!” চিৎকার দিয়ে উঠলো সে। ভারসাম্য হারিয়ে বাম দিকে কাত হয়ে পড়ে গেলো। ডানহাত দিয়ে আতরের কাঁধ ধরার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হলো সে। মাটিতে আছড়ে পড়ার আগে তার মনে হলো কয়েক মুহূর্ত শূন্যে ভেসে ছিলো!
.
অধ্যায় ৫
“…কোমল বাছুর ডোর ছিন্ন হয়ে যায়,
মদিরা উথলে নাকো মদির আঁখিতে।
কেহ কারে নাহি চিনে আঁধার নিশায়…”
মৃদু ভলিউমে যে গানটা বাজছে সেটার কথাগুলো খুব খেয়াল না করলে বোঝা যাবে না। তবে তাতে কোনো সমস্যা নেই, সবটাই তার মুখস্ত।
সাধারণত এভাবে রকিংচেয়ারে দোল খেতে খেতে গান শোনার সময় বিড়বিড় করে গানের সাথে ঠোঁট মেলায়, তবে আজ তার ঠোঁটজোড়া
পুরোপুরি স্থির। চোখ দুটো শূন্যে নিক্ষেপ করে ভেবে যাচ্ছে। আস্তে করে চেয়ারের পাশ থেকে কফি টেবিলের উপরে রাখা গ্লাসটা হাতে তুলে নিলো। অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে লাল টকটকে তরলে ভর্তি ওটা। গ্লাসটা নাকের সামনে নিয়ে গন্ধ নিলো প্রথমে, তারপর চুমুক দিয়েই বন্ধ করে ফেললো দু চোখ। লাল তরল মুখের ভেতরে কিছুক্ষণ রেখে দিয়ে অনুভব করলো এর স্বাদ। গন্ধ।
আনমনেই আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো যেনো। গলা দিয়ে লাল তরলটা নামিয়ে দিয়ে চোখ খুললো সে। আকাশে ভেসে থাকা চাঁদের দিকে তাকালো। তিন-দিন পর পূর্ণিমা হবে। চাঁদটা এখন পূর্ণতার পথে। অল্প কিছু বিচ্ছিন্ন মেঘের টুকরো চাঁদটাকে আড়াল করে দিয়ে পরক্ষণেই চলে যাচ্ছে। দোতলার বারান্দায় বসে রকিংচেয়ারে দোল খেতে খেতে দৃশ্যটা দেখতে মনোরম লাগছে। গ্লাসটা সরিয়ে গভীর করে নিঃশ্বাস নিলো। সদ্য ফোঁটা হাসনাহেনা ফুলের গন্ধে তার বাগানটা অপার্থিব হয়ে উঠেছে।
সে জানে হাসনাহেনা ফুলের গন্ধ মিষ্টি। যেমন গোলাপের গন্ধ নোনতা, আর জংলী ফুলের গন্ধ তেতো। প্রকৃতির প্রতিটি গন্ধেরই এরকম স্বাদ রয়েছে। একটি গন্ধ আরেকটি গন্ধের সাথে মেশানো যায়; একটি স্বাদের সাথে আরেকটি স্বাদেরও মিশ্রণ হয়। তবে মানুষ গন্ধের ব্যাপারে সবচেয়ে আনাড়ি। শব্দ-স্বাদ-দৃষ্টি-স্পর্শ, এগুলোর ব্যাপারে মানুষ যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। শব্দকে ছয়টি সুরে-সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-বেধেছে। স্বাদকে টক, ঝাল, মিষ্টি, নোনতা আর তেতো এই পাঁচটি ভাগে আলাদা করেছে। জগতের সকল রঙকে সাতটি রঙে ভাগ করেছে মানুষ। আর স্পর্শ সবচেয়ে সথুল ইন্দ্রিয়; গরম-ঠাণ্ডা, নরম-কোমল, শক্ত-তরল-বায়বীয়-এর বাইরে আর কোনো অনুভূতি নেই। কিন্তু গন্ধের বেলায় এসে বিপাকে পড়ে গেছে। গন্ধ কয় প্রকার-কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারে না। মুচকি হাসলো সে। ভালো করেই জানে এর কারণ কি। গন্ধ সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর। এটা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। নানারকম গন্ধের সাথে মিশে যায় দ্রুত। এই মেলামেশাকে থামানো যায় না। অদৃশ্যভাবে, সবার অগোচরে ঘটে যায়, সেজন্যে আলাদা করাটাও খুব কঠিন হয়ে পড়ে। শৈশব থেকে মানুষ গন্ধ নেবার ইন্দ্রিয় ‘নাক’ নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে। এ জগতের প্রায় সবকিছুরই গন্ধ আছে। সেগুলো ভেসে বেড়ায় বাতাসে। আর বাতাস মানেই সর্বত্রগামী। ফলে প্রকৃতিতে এক একটি গন্ধ খুব বেশি সময় নিজস্বতা ধরে রাখতে পারে না।