“হ্যাঁ, কিন্তু…”
“জলদি আসেন, বুইড়া গেরামে ফিরা চাইছে। আবার কই যায় না-যায় তার কি কুনো ঠিক আছে।”
“কার কথা বলছেন?”
“গেলেই দেখবার পারবেন…আহেন তো।”
আর কিছু না বলে হাতঘড়িটা পরতে পরতে জানতে চাইলো সে, “এখানে মোবাইলে টাকা ভরা যাবে কোথায়? ব্যালান্স একেবারে শেষ হয়ে গেছে,” টেবিল থেকে মোবাইলফোনটা পকেটে ভরে নিলো।
“এই তো, ডিসপিন্সারিটার লগেই একটা আছে। চলেন, যাওনের সময় ভইরা নিয়েন।”
ছফা দরজা লাগিয়ে চুপচাপ বের হয়ে গেলো আতর আলীর সাথে। তার মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকলেও কিছুই জানতে চাইলো না। তার দরকার তথ্য, আর সেটা পেতে হলে এই লোকটাকেই বেশি প্রয়োজন।
হোটেল থেকে বের হয়ে কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে একটা ওষুধের দোকানের পাশের দোকান থেকে ব্যালান্স ভরে নিলো সে। ভাগ্য ভালো দোকানটা খোলা আছে। দোকানির সাথে আতর আলীর কথা-বার্তা শুনে। বোঝা গেলো ইনফর্মারের সাথে বেশ ভালো খাতির। পথে কোনো যানবাহন। নেই দেখে হেঁটেই রওনা দিলো তারা। আতরের ভাষায় তাদের গন্তব্য বেশি দূরে নয়। ছফা অবশ্য এ-কথায় খুব একটা আস্থা রাখতে পারছে না। গ্রামের লাকজনকে সে ভালো করেই চেনে। এরা সব সময় ‘তালগাছ’ দেখাবে!
সুনসান মহাসড়ক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তারা। দূর থেকে একজোড়া হেডলাইট দেখা গেলো। কোনো বাস-ট্রাক হয়তো আসছে। অনেকটা পথ হাটার পর মহাসড়ক থেকে ডানদিকে চলে গেছে। এরকম একটি মেঠোপথের দিকে পা বাড়ালো আতর, তার পেছন পেছন ছফা। মাথার উপরে পৌণে-আধখান চাঁদের আলো ঘুটঘুটে অন্ধকার কিছুটা ফিকে করে দিয়েছে। এমন মৃদু আলোয় পথ চলতে অভ্যস্ত নয় বলে ইনফর্মারের বড় বড় পা ফেললে তার পক্ষে তাল মেলানো সহজ হলো না, একটু পেছনে পড়ে গেলো সে। পকেট থেকে মোবাইলফোনটা বের করে ডিসপ্লের আলোতে আতরের পেছন পেছন পথ চলতে শুরু করলো।
হাঁটতে হাঁটতেই একটু পেছন ফিরে তাকালো ইনফর্মার। “আন্ধারে পবলেম হইতাছে নি, ভাইজানের?”
“না, না…ঠিক আছে।”
“আপনে কইলাম সাম্বাদিক না,” সামনের দিকে তাকিয়েই বললো আতর।
“কি?” ছফা চমকে উঠলো।
একটা সিগারেট ধরালো ইনফর্মার। “আপনে আইছেন বিয়া করতে. মাইয়ার ব্যাপারে একটু খোঁজ নিতাছেন। বুঝলেন?”
“আরেকটু খুলে বলেন।”
আবারও পেছন ফিরে তাকালো সে, “বুঝলেন না…টেকনিক আর কি। সাম্বাদিক ঠুনলে বুইড়া তো কুনো কথা কইবো-ই না, পাদও দিবো না। সব বন কইরা বয়া থাকবো।”
“আচ্ছা,” ছফা এবার বুঝতে পারলো। “কিন্তু মেয়েটা কে..মানে কাকে দেখতে এসেছি?”
“আবার কে…ঐ বেটি!”
ছফা প্রায় হোঁচট খেতে যাচ্ছিলো তবে সেটা মেঠোপথের উপরে পড়ে থাকা কোনো মাটির চাকার জন্য নাকি কথাটার অভিঘাতে বোঝা গেলো না।
“বুইড়া কইলাম মানুষ ভালা খালি মাথায় এই ছিট আছে…একবার মিজাজ বিগড়াইলে আর কিছু কইবো না। আমাগো এমপিসাবরেও হে পান্তা দেয় না…মুখের উপরে কথা কইয়া দেয়,” সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো, “তয় মাথাটা একেবারে সলিড। সব কিছু জানে। এইখানকার সব তার মুখস্ত।”
“আমি তো জানতাম এখানকার সব খবর আপনি রাখেন,” ছফা আস্তে করে বললো পেছন থেকে। “সেজন্যে লোকজন আপনাকে বিবিসি বলে। ডাকে। এখন দেখছি সিএনএন-ও আছে!”
হে-হে-হে করে হাসলো আতর। “হের কাছে আপনে সব খবর পাইবেন। কিন্তু এই জমানার কুনো খবর পাইবেন না…সব পুরানা আমলের খবর।”
“বুঝলাম না?”
আবারো পেছন ফিরে তাকালো পুলিশের ইনফর্মার। “বুইড়া পুরানা আমলের মানুষ…হে খালি পুরানা জমানার কথা জানে…এখনকার কুনো খবর হে রাখে না৷”।
ওহ্ হিস্টোরি চ্যানেল! মনে মনে বললো ছফা তবে মুখে বললো, “লোকটা কি করে?”
“মাস্টর আছিলো, এহন কাম-কাইজ কিছু করে না। আমাগো এমপি হের চাকরি নট কইরা দিছে।”
“কেন?”
“এমপিসাব কইছিলো সুন্দরপুর প্রাইমারি স্কুলটার নাম বদলাইয়া হের বাপের নামে রাখতে…মাস্টর খুব ঘাড়ত্যাড়া মানুষ..বুঝলেন? মুখের উপর কইয়া দিছে, এইটা সে বাঁইচা থাকতে হইতে দিবো না।”
“কারণটা কি?”।
“এমপির বাপ হামিদুল্লা তো গণ্ডগোলের সময় মিলিটারিগো লগে পিচকমিটি করছিলো…মাইনষে তারে হামিদ্যা-রাজাকার কয় এহনও। হে কইলাম মেলা মানুষ মারছে।”
“স্কুলের নামটা কি বদলাতে পেরেছিলেন আপনাদের এমপি?”
পেছন ফিরে না তাকিয়েই বললো আতর, “আরে না…কেমনে বদলাইবো? কইলাম না, মাস্টর বাগড়া দিছে।”
অবাক হলো ছফা। “সামান্য একজন মাস্টার হয়ে তিনি কিভাবে এটা করতে পারলেন?”
“মাস্টরের পুরানা ছাত্ররা আছে না…হেরা তো বিরাট বড় বড় জায়গায় আছে…হেরা আবার মাস্টররে খুব মাইন্য করে…বুইড়্যা ঢাকায় গিয়া পুরানা ছাত্রগো দিয়া এমন টাইট দিছে…এমপিসাব আর স্কুলের নাম বদলাইবার সাহস করে নাই
“আচ্ছা।”
“এইটা কইলাম পেপারে আইছিলো।”
“তাই নাকি?”
“হ। রাজাকারের নামে স্কুল হইবো এই কথাটা পেপারে আহনের পরই ক্যাচাল লাইগা যায়।”
ছফা বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার হলেও ভদ্রলোকের ক্ষমতা নেহায়েত কম নয়। তাদের গ্রামেও এরকম দু-একজন মাস্টার আছে, যাদেরকে সবাই খুব শ্রদ্ধা করে…পুরনো ছাত্রদের অনেকেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত, ফলে এক ধরণের ক্ষমতাও তৈরি হয় তাদের।
“এই গেরামের সবতে একদিনের জইন্য হইলেও হের কাছে পড়ছে।” আতর আবার বলে উঠলো। “খুব ভালা মাস্টর। আমার পোলারেও পড়াইছে৷”