মানুষের মন জয় করতে হলে তার পেট জয় করা চাই-নুরে ছফা বুঝতে পারলো, এই রেস্তোরাঁ ভালোভাবেই সেটা করতে পেরেছে। কিন্তু বিজয়িনীর দেখা পাচ্ছে না। সে জানে ঐ দরজার ওপাশেই আছে রহস্যময় সেই নারী।
আরো কিছুক্ষণ বসে থাকার পর নুরে ছফা ঠিক করলো চলে যাবে। দূর থেকে ওয়েটারকে ইশারা করে বলে দিলো বিল নিয়ে আসার জন্য। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে চলে গেলো ছেলেটা। এমন সময় তাকে অবাক করে দিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো এমপিসাহেব। বিরসমুখে চুপচাপ রবীন্দ্রনাথ থেকে চলে গেলো সে।
বিল নিয়ে ওয়েটার হাজির হলে ছফা প্রায় উদাস হয়েই পাঁচশ’ টাকার একটি নোট বাড়িয়ে দিলো, যদিও তার দৃষ্টি মেইনগেটের দিকে। বড় বড় জানালা দিয়ে দেখতে পেলো দলবল নিয়ে গাড়িতে উঠে চলে যাচ্ছে সুন্দরপুরের এমপি। লোকটার চোখেমুখে যে অভিব্যক্তি দেখেছে তাতে নিশ্চিত করে বলা যায়, মুশকান জুবেরির সাথে স্থানীয় এমপির সাক্ষাৎকারটি সুখকর কিছু ছিলো না। ঝগড়া? মনোমালিন্য? নুরে ছফা অনুমাণ করার চেষ্টা করলো।
“স্যার।”
তাকিয়ে দেখলো ওয়েটার বাকি টাকা নিয়ে ফিরে এসেছে। ভাঙতি টাকাগুলো পকেটে ভরতে যাবে অমনি দেখতে পেলো ঐ দরজা খুলে বেরিয়ে আসছে সেই রহস্যময়ী! এই প্রথম কাউকে দেখে তার বয়স আন্দাজ করতে পারলো না ছফা।
সাদা-লালের জামদানি শাড়ি, তার উপরে টকটকে লাল উলের লং কার্ডিগান। চুলগুলো সুন্দর করে খোঁপা করা, তাতে বেলি ফুলের মালা পেঁচানো। কপালে সিঁদুররঙা টিপ, চোখে দুর্দান্তভাবে কাজল দেয়া। ছফা কখনও এভাবে কাজল দিতে দেখে নি কোনো নারীকে। কাজলের টংটি তার চোখদুটোকে দান করেছে অপার্থিব এক ভঙ্গি।
এতোক্ষণ ধরে সুস্বাদু খাবারের ঘোরে ছিলো যারা তাদেরও ধ্যান ভাঙলো, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলো চোখধাঁধানো রূপ নিয়ে অভিজাত পদক্ষেপে হেঁটে যাচ্ছে এক নারী।
ছফার টেবিলের পাশ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ করেই তাকালো সে। বড়জোর দুই সেকেন্ড। তারপর আবার চোখ নামিয়ে সোজা চলে গেলো মেইনগেটের দিকে। তার দৃষ্টি নিক্ষেপ এবং দৃষ্টি সরিয়ে নেয়ার মধ্যে অদ্ভুত একটি ভঙ্গিমা ছিলো।
কয়েক মুহূর্ত মন্ত্ৰতাড়িত হয়ে বসে রইলো ছফা। সে নিশ্চিত, মহিলা তার দিকে তাকানোর সময় অদ্ভুতভাবে হেসেছিলো। সেই হাসি এতোটাই ক্ষীণ যে ওটাকে ঠিক হাসি বললেও ভুল বলা হবে। কেবল ঠোঁটের একপ্রান্ত একটুখানি ঢেউ খেলে যাওয়া।
কিন্তু ছফা বুঝতে পারলো না এই হাসির মানে কী?
.
অধ্যায় ৪
রাত ন’টার পরই সুনসান হয়ে উঠলো সুন্দরপুর। স্থানীয় লোকজন গর্ব করে বলে টাউন, আদতে মফশ্বল শহর বললেও বেশি বলা হবে। এ যেনো বিশুদ্ধ একটি গ্রাম। সেই গ্রামের বুক চিড়ে মহাসড়ক চলে গেছে। সেই সড়কের দু পাশে গড়ে উঠেছে কিছু দোকানপাট। নিম্নমানের একটি আবাসিক হোটেল থাকলেও কোনো ব্যাঙ্ক কিংবা সরকারী দপ্তর নেই, আছে শুধু পল্লী বিদ্যুতের ছোটোখাটো একটি অফিস।
বিছানাঘেষা জানালার সামনে বসে কানে ফোন চেপে রেখেছে ছফা। নেটওয়ার্কের সমস্যা হচ্ছে বলে জানালার সামনে বসে কথা বলছে, তারপরও পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিনবার লাইন কেটে গেছে, কথাবার্তাও মাঝেমধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে দুর্বল সিগন্যালের কারণে। দশ-বাই আট ফুটের একটি রুম। সিঙ্গেল খাট আর আমকাঠের টেবিল-চেয়ার রাখার পর খুব বেশি জায়গা নেই।
“.কমপক্ষে সপ্তাহখানেক লাগতে পারে..তবে আমি শিওর না…” একটু জোরেই বললো সে। “…হোমরাচোমরা লোকজনের সাথে মহিলার খাতির…সাবধানে কাজ করতে হবে.. টের পেয়ে গেলে কাজটা করা কঠিন। হয়ে যাবে…” মুশকান জুবেরির সেই রহস্যময় চাহনির কথাটা মনে পড়ে গেলো তার। এরইমধ্যে কি মহিলা টের পেয়ে গেছে? অসম্ভব! সে এমন কিছু করে নি যে টের পেয়ে যাবে। এখানে নেটওয়ার্ক খুব খারাপ…আমি সময়। আর সুযোগ পেলে নিজেই ফোন করবো…ওকে?”
ঠিক এমন সময় কেউ তার দরজায় নক করলে ফোনটা কান থেকে সরিয়ে বলে উঠলো, “কে?”
“আমি আতর।”
দরজার ওপাশ থেকে কণ্ঠটা শোনামাত্র, “এখন রাখি পরে কথা হবে,” বলে দ্রুত উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো সে।
“আপনের পঞ্চাশ ট্যাকা সেভ কইরা দিলাম,” দাঁত বের করে বললো আতর। “এমুন ফাঁপড় মারছি যে পাতলা-পায়খানা শুরু কইরা দিছে ম্যানেজার।”
“আরে, এটার তো কোনো দরকার ছিলো না, একটু বিরক্তির সাথে বলেই আতরকে ঘরে ঢুকতে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। “বসেন।” ঘরের একমাত্র চেয়ারটা দেখিয়ে বললো সে। নিজে বসলো বিছানার উপর।
“রাইতের খানা খাইছেন?”
“হ্যাঁ।”
ইনফর্মার মুখে রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলেও সেটা অশ্লীল দেখালো। “ওই বেটির ওইখানে?”
আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।
“হি-হি-হি,” দাঁত বের করে হাসলো ইনফর্মার।
ছফা কিছু বললো না।
“ভালা ভালা,” বুঝতে পারছে না হাসিটা কিভাবে থামাবে। প্রথমে শব্দহীন করলো তারপর অভিব্যক্তি পাল্টে বললো, “গাঞ্জা-মদ কিছু লাগবো নি?”
“না। আজ ইচ্ছা করছে না। লাগলে আমি জানাবো আপনাকে।”
“ঠিক আছে,” একটু হতাশ হয়ে বললো আতর। “তাইলে এহন আমার লগে চলেন, আপনেরে এক জায়গায় নিয়া যামু।”
অবাক হলো ছফা। “কোথায়?”
“আপনে তো হের ব্যাপারে অনেক কিছু জানবার চান…কইথেকা আইলো, কেমনে আইলো..না?”