আতরকে বিদায় দিয়ে পকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে ধরালো সে। দীর্ঘ একটা টান দিয়ে তাকালো জ্বলজ্বল করতে থাকা রবীন্দ্রনাথের দিকে। চারপাশে ঘন অন্ধকারে লালচে আলোর একমাত্র সাইনটি কিছুক্ষণ পর পর কয়েক সেকেন্ডের বিরতি দিয়ে নিভে যেতেই জ্বলে উঠছে আবার। এক রহস্যময়তার ইঙ্গিত দিচ্ছে যেনো। সত্যি বলতে এমন অদ্ভুত নামের রেস্টুরেন্টের কথা সে জীবনেও শোনে নি, আর এখন চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছে।
সিগারেটটা আর্ধেক শেষ হতেই ফেলে দিলো। হাত দিয়ে মাথার বিতস্ত্র চুলগুলো ঠিক করে পা বাড়ালো রবীন্দ্রনাথের দিকে।
.
অধ্যায় ৩
সন্ধ্যা সাতটার আগেই দ্বিতীয় বারের মতো রবীন্দ্রনাথে এলো সে।
অদভুত রেসটুরেন্টের সামনের খোলা প্রাঙ্গণে কমপক্ষে ছয়-সাতটি প্রাইভেটকার আর মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে আছে। ধীরপায়ে রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলো বসার মতো খালি কোনো আসন নেই। অবশ্য ভালো করে চোখ বোলানোর পর দূরে, বামদিকে একটি টেবিল খালি দেখতে পেলো। আরো অদ্ভুত ব্যাপার হলো চারজন ওয়েটার দেখতে পাচ্ছে এখন। তারা সবাই শান্তশিষ্টভাবে টেবিল থেকে টেবিলে অর্ডার নিচ্ছে। নয়তো খাওয়া শেষে বিল দিচ্ছে কাস্টমারকে। দিনের বেলায় এরা কোথায় ছিলো? তখন মাত্র একজন ওয়েটারকে দেখেছে।
খালি আসনে বসেই টেবিল থেকে মেনুটা তুলে নিলো। আসলে মেনুর আইটেম নিয়ে তার মধ্যে কোনো আগ্রহ নেই। এর আগে যা খেয়েছিলো তা ই খাবে আবার। সে তো এখানে মনভোলানো খাবার খেতে আসে নি, যদিও খাবারগুলো তাকে আকর্ষণ করছে।
“স্যার?” দুপুরের সেই ওয়েটার ছেলেটা এসে বললো।
“দুপুরে যা খেয়েছিলাম তা-ই নিয়ে আসো,” সঙ্গে সঙ্গে অর্ডার দিয়ে। দিলো সে।
“নতুন কিছু ট্রাই করবেন না?”
“নতুন?”
আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো ওয়েটার। “ডিনারের সময় নতুন কিছু আইটেম ট্রাই করে দেখতে পারেন…মানে ড্রিঙ্কস আইটেমটা বাদে অন্য কিছু?”
“যেমন?”
“আপনি চা কিংবা কফি নিতে পারেন?”
“তোমাদের চা-কফিও কি অসাধারণ হয় নাকি?”
ওয়েটার নির্বিকার রইলো। কাস্টমারের হাসির জবাবে সে একটুও হাসলো না। “এখানকার সবকিছুই অসাধারণ…এটা আমরা বলি না…মেহমানরা বলে।”
“গুড।” ভাবলো ব্যঙ্গাত্মক সুরে আর কথা বলা ঠিক হবে না। তাহলে তা-ই দাও।”
ওয়েটার চুপচাপ চলে গেলে আশেপাশে তাকালো সে। যথারীতি আয়েশ করে সুস্বাদু খাবার গলাধকরণ করা কাস্টমারে পরিপূর্ণ! আঙুল চাটার দৃশ্য আবারও দেখতে পেলো। এই রেস্টুরেন্টের সব কাস্টমার যেনো কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে গিয়ে খাবার খাচ্ছে। এই ঘোরের মধ্যে সে নিজেও পড়ে গেছিলো আজ।
একটু পরই টের পেলো ঘরের মধ্যে অদ্ভুত সুন্দর একটি গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। এটা কোনো খাবারের গন্ধ নয়-অন্তত তার কাছে তাই মনে হচ্ছে। পারফিউম? হতে পারে।
রবীন্দ্রনাথের প্রবেশপথে একটু শোরগোল হতেই সেদিকে তাকালো। দেখতে পেলো পাঁচ-ছয়জন লোক ঢুকে পড়ছে হুরমুর করে। তাদের মধ্যে স্পষ্টতই নেতাগোছের একজন আছে, তাকে ঘিরে রেখেছে বাকি চার পঁচজন। নেতার গায়ে পাজামা-পাঞ্জাবি।
ঘরে কোনো টেবিল খালি নেই। সবগুলো দখল করে নিয়েছে ভোজনরসিক মেহমানের দল। নেতার চামচাঁদের চোখে এটা ধরা পড়লো খুব দ্রুত। ঘরের মাঝখানে এসে বিব্রত ভঙ্গিতে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইলো নেতা, বুঝতে পারছে না কী করবে। এখানকার প্রায় সব কাস্টমারই বাইরে থেকে এসেছে তাই তাকে দেখে কেউ চিনতে পারছে না, সম্মান দেখিয়ে উঠেও দাঁড়াচ্ছে না। একজন ক্ষমতাসীন রাজনীতিকের কাছে এরচেয়ে অসহনীয় ব্যাপার আর কী হতে পারে! বেচারা না পারছে মানুষজনকে খাওয়ার টেবিল থেকে উঠিয়ে দিতে, না পারছে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে।
বেচারিকে মুক্তি দিলো একজন ওয়েটার। দৌড়ে এসে নীচুস্বরে কিছু একটা বললে নেতার কালোমুখটি উজ্জ্বল হয়ে গেলো মুহূর্তে। সঙ্গে থাকা লোকগুলোকে কিছু একটা বলে ওয়েটারকে সঙ্গে নিয়ে ঘরের শেষমাথায় যে দরজা রয়েছে সেখানে চলে গেলো সে।
“কোনো ভিআইপি এসেছে নাকি?” একটু পর ওয়েটার খাবার নিয়ে এলে স্বাভাবিক কৌতূহলে জানতে চাইলো ছফা।
“হুম। এখানকার এমপিসাহেব এসেছেন,” খাবার রাখতে রাখতে বললো ওয়েটার।
“তোমাদের মালিকের সাথে দেখা করতে এসেছে?”
সোজা হয়ে দাঁড়ালো ছেলেটা, মুচকি হেসে চলে গেলো।
আনমনে খাবার খেতে লাগলো নুরে ছফা। তার দৃষ্টি ঘরের এককোণে থাকা ঐ দরজার দিকে। ওখান দিয়েই এমপিসাহেব ঢুকে পড়েছে একটু আগে। সঙ্গে থাকা তার চ্যালা-চামুণ্ডারা অবশ্য বাইরে চলে গেছে।
খুবই আস্তে আস্তে খেতে শুরু করলো সে, আর কিছুক্ষণ পরই আবিষ্কার রলো ইচ্ছে করলেই সুস্বাদু খাবার ধীরে ধীরে খাওয়া যায় না। তবে সচেতনভাবেই আঙুল চাটার মতো অরুচিকর কাজ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারলো এবার।
খাওয়া শেষে চুপ মেরে বসে রইলো। অনেক সতর্ক থাকার পরও টের পেলো তার চোখ বার বার চলে যাচ্ছে ঘরের শেষমাথায় প্রাইভেট রুমের দরজার দিকে। দরজা থেকে চোখ সরিয়ে খাবার খেতে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকালো। সবার মুখে এক ধরণের প্রশান্তি। আয়েশ করে খাবার খাচ্ছে। মানুষ যখন অসম্ভব মজাদার খাবার খায় তার মুখ এমনিতেই বন্ধ থাকে, কথা বলতে ইচ্ছে করে না। এরাও প্রায় নিঃশব্দে আহারে নিমগ্ন। তিন চারজনের দলবেঁধে যারা এসেছে কেবল তারাই একটু আধটু কথা বলছে।