- বইয়ের নামঃ রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি ২
- লেখকের নামঃ মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
- প্রকাশনাঃ বাতিঘর প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
১. ট্যাক্সিক্যাবের দরজা খুলে
রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি
মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
মুখবন্ধ
গন্ধটা যেনো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো তাকে।
ট্যাক্সিক্যাবের দরজা খুলে মাটিতে পা রাখার সাথে সাথে টের পেলো বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে অদ্ভুত একটি গন্ধ। এ জীবনে নেয়া যতো গন্ধ আছে তার মধ্যে এটি একেবারেই অজ্ঞাত। এর মধ্যে যে সম্মোহনী ক্ষমতা রয়েছে সেটাও টের পেলো খুব দ্রুত।
টানা চার-পাঁচ ঘণ্টা ক্যাবে করে ভ্রমণ করার পর এমনিতেই খিদেয়। পেট চৌ চৌ করছিলো, প্রলুব্ধকর গন্ধে সেটা যেনো বিস্ফোরণের মতো ছড়িয়ে পড়লো এবার। তার থেকে মাত্র বিশ গজ দূরে, রাস্তার পাশে রেস্টুরেন্টটি দেখতে পেয়ে সানগ্লাস খুলে ভালো করে তাকালো। সাইনবোর্ডে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে অদ্ভুত আর অপ্রচলিত নামটি। দুই ঠোঁটে চেপে রাখা জ্বলন্ত সিগারেটে জোরে টান দিলো সে। পা বাড়ানোর আগে ট্যাক্সি ক্যাবের দিকে ফিরে তাকালো। ড্রাইভার জানালা দিয়ে মাথা বের করে রেখেছে। তার সাথে চোখে চোখ পড়তেই মাথা নেড়ে সায় দিলো লোকটি। তাকে চলে যাবার ইশারা করতেই হুস করে শব্দ তুলে ট্যাক্সিক্যাবটি চলে গেলো। তার চোখের সামনে যে রেস্টুরেন্টটি দাঁড়িয়ে আছে সেটা গর্বসহকারেই জানান দিচ্ছে :
রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি!
একদম সত্যি কথা। আমিও কখনও এখানে আসতাম না, যদি..
বুক ভরে গন্ধটা নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালো।
মহাসড়কের পাশে চমৎকার একটি বাংলো বাড়ির মতো একতলার এই রেস্টুরেন্টটির সামনে লম্বা বারান্দা, সেই বারান্দার উপরে সবুজ রঙ করা টিনের ছাউনি। বড় বড় ফ্রেঞ্চ জানালা আর নক্সা করা বিশাল একটি কাঠের দরজা-এক নজরেই জায়গাটা মানসপটে স্থান করে নেবে। রাস্তার পাশে এমন চমৎকার ছিমছাম রেসটুরেন্ট খুব কমই আছে। মহাসড়কের পাশে যেসব রেস্টুরেন্ট থাকে সেগুলো মূলত যাত্রিবাহী বাসের স্টপেজ হিসেবে কাজ করে। বড়বড় বাস-সার্ভিস কোম্পানি নিজেরাই কিছু রেস্টুরেন্টের মালিক। ওগুলোর সামনে বিশাল একটি খালি জায়গা রাখা হয় বাস-কোচ রাখার জন্য কিনতু এই অদভুত রেটুরেন্টটি সে-রকম নয়। এর সামনে যে খোলা জায়গাটি আছে সেখানে বড়জোর দশ-বারোটি প্রাইভেটকার রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। সম্ভবত দূরপাল্লার কোনো বাস-কোচ এখানে রাখা হয় না। তাহলে কোথায় রাখা হয়?
জবাবটা পেয়ে গেলো রেস্টুরেন্টের বামদিকে।
ছিমছাম রেস্টুরেন্টের এক-দেড়শ’ গজ দূরে একটি পেট্রলপাম্প। সেখানে অনেকগুলো বাস-ট্রাক-কোচ দাঁড়িয়ে আছে।
চারপাশে তাকিয়ে রেস্টুরেন্টের দিকে নজর দিলো আবার। এ মুহূর্তে সামনের প্রাঙ্গণে সাদা রঙের একটি প্রাইভেটকার আর কালো রঙের মাইক্রোবাস ছাড়া কিছু নেই।
দুপুর গড়িয়ে গড়িয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বিকেলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সবকিছু যেনো ঝিমিয়ে পড়েছে এখানে। মহাসড়কটিও অলসভাবে পড়ে আছে। অনেকক্ষণ পর পর দুয়েকটা বাস-ট্রাক যাচ্ছে-আসছে তার উপর দিয়ে।
রেস্টুরেন্টের আশেপাশে ডোবা-নালা আর ধানক্ষেত। পেছনে, বহু দূরে একটি গ্রামীণ জনপদ। বিস্তীর্ণ ক্ষেতের মাঝে গুচ্ছ-গুচ্ছ কৃষকের বসতবাড়ি। সরু একটি পথ চলে গেছে সেই বসতবাড়িগুলোর দিকে। মেঠোপথের দু-ধারে বিস্তীর্ণ আবাদি-জমি। মাঝে-মাঝে ছোটো-বড় ডোবা পুকুর, খাল। চারদিকে তাকালে সবুজ প্রান্তরে আকাশ মিশে যাবার সেই চিরায়ত দৃশ্যই চোখে পড়বে।
বারান্দার কাছে এসে একটু থেমে সুখটান দিয়ে সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো। ধূমপান নিষেধ লেখা সাইনের পাশেই নক্সা করা বিশাল দরজা, সেটা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই থমকে গেলো কয়েক মুহূর্তের জন্য। হালকা ভলিউমে রবীন্দ্রসঙ্গীত ভেসে বেড়াচ্ছে। অবাক হলো না সে। এটা প্রত্যাশিতই ছিলো, বিশেষ করে এমন একটি রেসটুরেন্টে।
ঘরের ভেতরে নজর দিলো এবার। সাজসজ্জা আর পরিবেশ একদমই আলাদা। টেবিল-চেয়ারগুলো একটু ভিন্নভাবে সাজানো। এক একটা রাউন্ড টেবিল ঘিরে আছে তিন থেকে চারটা করে চেয়ার। এরকম পাঁচ-ছয়টি টেবিল আছে ঘরে। সর্বোচ্চ বিশ-পঁচিশজন বসতে পারবে। এই বিশাল জায়গাটি যতো কাস্টমার ধারণ করতে পারে তার অর্ধেকের বসার ব্যবস্থা রয়েছে। এর মালিক যেনো স্পষ্ট একটি বার্তা দিচ্ছে-সবাইকে আমি নিছক টাকা। কামানোর জন্য রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করি না। আমি যেটা করি সেটা এক ধরণের শিল্প!
শীতের এই পড়ন্ত বিকেলে মাত্র দুটো টেবিলে পাঁচ-ছয়জন কাস্টমার আয়েশ করে খাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে দীর্ঘ ভ্রমণপথে বিরতি দিয়ে খেয়ে নিচ্ছে এরা বা অন্য কারোর কাছ থেকে এই হোটেলের সুনাম শুনে চলে এসেছে হয়তো। তাকে ঢুকতে দেখে কিছু কাস্টমার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলো, তবে খুব বেশিক্ষণের জন্য নয়, আবারো মনোযোগ দিলো নিজেদের সামনে রাখা সুস্বাদু খাবারের দিকে।
চারপাশে তাকিয়ে কোনো ওয়েটার দেখতে পেলো না। আস্তে করে কয়েক পা হেঁটে সামনের একটি টেবিলে বসে পড়লো সে। বেশ আরামদায়ক বসার ব্যবস্থা। সাধারণত রেস্টুরেন্টগুলো এরকম আরামের। ব্যবস্থা করে না। হাত-পা ছড়িয়ে বসা যায় এখানে। সেও তাই করলো। দীর্ঘ ভ্রমনে সারা শরীর আড়ষ্ট হয়ে আছে।