টুনি বলল, “তুমি তার খাতার প্রথম পৃষ্ঠায় লিখ ছাগল।”
ছাত্রছাত্রীরা শুধু নিজের সমস্যা নিয়ে আসতে লাগল তা না। নিজেদের বাসার বিভিন্ন মানুষের সমস্যা নিয়েও আসা শুরু করল। একজন এসে বলল, “ভাইয়া জানি কীরকম হয়ে গেছে। সারাক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ায়, আর নিজেকে দেখে।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “চুলে জেল দেয়?”
“হ্যাঁ।”
“শরীরে পারফিউম?”
“হ্যাঁ।”
“বয়স কত? ষোল-সতেরো?”
“হ্যাঁ।”
টুনি বলল, “নরমাল। হরমোন কিক করেছে।”
যে সমস্যাটা নিয়ে এসেছে সে বলল, “তার মানে কী?”
“তার মানে এই বয়সের ছেলেরা মেয়েদের সামনে নিজেদের সুন্দর দেখানোর জন্যে সাজুগুজু করে।”
“কেন?”
“তুমি এখন বুঝবে না। তোমার বয়স যখন ষোল-সতেরো হবে তখন বুঝবে।“
“তোমার বয়স কি মোল-সতেরো হয়েছে?”
“না।”
“তাহলে তুমি কেমন করে বুঝ?”
টুনি ইতস্তত করে বলল, “আমি তো ডিটেকটিভ–আমার বুঝতে হয়।”
আরেকজন এসে বলল, “আব্ব হঠাৎ মোচ কেটে ফেলেছে। এখন আব্বকে চেনা যায় না, দেখে মেয়ে মানুষের মতো লাগে।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “বয়স কত? চল্লিশের কাছাকাছি?”
“হ্যাঁ?”
“নরমাল। তোমার আব্বর মোচ পাকতে শুরু করেছে। প্রথমে একটা-দুইটা টেনে তুলে ফেলেছে, এখন আর কুলাতে পারছে না, তাই পুরোটা কামিয়ে ফেলেছে।”
শুধু যে বাসার সমস্যা নিয়ে এলো তা-ই না, এক-দুইজন তাদের মেডিক্যাল সমস্যা নিয়ে এলো। বেশিরভাগ সমস্যা অবশ্যি কাউকে বলার মতো না। একটা-দুইটা হয়তো একটু চিন্তা-ভাবনা করে বলা যেতে পারে। যেমন একটা ছেলে অনেকক্ষণ ইতস্তত করে বলল। “আমি যখন হিসু করি তখন রং হয় হলুদ, ফান্টার মতো।”
টুনি তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “বেশি করে পানি খাও তাহলে রং হবে সেভেনআপের মতো। আর যদি না খাও–”
ছেলেটা শুকনো মুখে বলল, যদি না খাই?”
“তাহলে আস্তে আস্তে তোমার হিসুর রং হয়ে যাবে কোকের মতো।”
ছেলেটা ফ্যাকাশে মুখে তখনই ছুটে বের হয়ে গেল, একটু পরেই দেখা গেল সে ঢকঢক করে পানি খাচ্ছে।
.
তবে টুনির কাছে সবচেয়ে চমকপ্রদ সমস্যাটা নিয়ে এলো মৌটুসী। একদিন যখন আশেপাশে কেউ নেই তখন মৌটুসী তার কাছে এসে বলল, “টুনি তুমি তো ডিটেকটিভ।”
টুনির ক্লাশের ছেলে-মেয়েরা সবাই সবাইকে তুই করে বলে, মৌটুসী ছাড়া। তার সাথে কারো ভাব নেই তাই সে সবাইকে তুমি তুমি করে বলে। টুনি মৌটুসীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি ডিটেকটিভ এখনো হই নাই। হওয়ার চেষ্টা করছি।”
মৌটুসী বলল, “দেখি তুমি কত বড় ডিটেকটিভ।” তারপর সে ব্যাগ থেকে একটা ভঁজ করা কাগজ বের করে টুনিকে দিয়ে বলল, “এই চিঠিটা কে লিখেছে বের করে দাও।”
টুনি কাগজটা খুলে দেখে পুরো চিঠিটা উল্টো করে লেখা। টুনি বলল, “যে লিখেছে সে তোমার পরিচিত। তাই এভাবে লিখেছে, যেন হাতের লেখা চিনতে না পারো।”
মৌটুসী বলল, “এটা কীভাবে পড়তে হবে জানো? একটা আয়নার সামনে ধরলে-”
টুনি বলল, “আয়না লাগবে না। তারপর কাগজটা জানালার আলোর দিকে উল্টো করে ধরল, মোটামুটি বেশ স্পষ্টভাবে লেখাটা সোজা হয়ে দেখা গেল। চিঠিতে লেখা :
মৌটুসী
আমি তোমাকে খুব হিংসা করি। আমরা কেউ কিছু পারি না কিন্তু তুমি গান গাইতে পারো, ছবি আঁকতে পারো, নাচতে পারো। শুধু তাই না, তুমি লেখাপড়াতেও এত ভালো। সবচেয়ে বড় কথা তুমি দেখতে এত সুন্দর। খোদা কেন সবকিছু একজনকে দিল, আমাদের কেন কিছু দিল না?
ইতি
একজন হিংসুক
টুনি চিঠিটা মৌটুসীকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “এই চিঠিটা তোমাকে কে লিখেছে বের করার কোনো দরকার নেই।”
“কেন?”
“এইটা সিরিয়াস কিছু না। কেউ ঠাট্টা করেছে।”
“ঠাট্টা?” মৌটুসী মনে হয় বেশ অবাক হলো। “ঠাট্টা কেন হবে?”
“ঠাট্টা না হলে এগুলো লিখে না। যদি চিঠিতে তোমাকে গালাগালি করত, ভয় দেখাত তাহলে সেটা বের করতে মজা হতো। এটা খুবই পানসে চিঠি।”
“তোমার কী মনে হয় এটা কি ক্লাশের কোনো ছেলে লিখেছে?”
“নাহ্। ছেলে লেখে নাই।”
“তুমি কীভাবে জানো?”
“আমাদের ক্লাশের কোনো ছেলেরই এখনো হরমোন কিক করে নাই। কোনো মেয়ে দেখতে সুন্দর কি না সেটা তারা জানে পর্যন্ত না! তাদের কাছে ছেলে-মেয়ে সুন্দর-ভ্যাবলা সব এক। এখন তারা ক্রিকেট খেলা ছাড়া আর কিছু বুঝে না।”
“তবুও তুমি কি বলতে পারবে এটা কে লিখেছে?”
“পারব।”
“কে?”
টুনি বলল, “সেটা তোমার জানার কোনো দরকার নাই। তারপর সে মৌটুসীর দিকে তাকিয়ে হাসার ভঙ্গি করল, যার অর্থ গোপন চিঠি নিয়ে আলোচনা শেষ। তাই একটু পরে মৌটুসী মন খারাপ করে চলে গেল।
পরের দিন সকালবেলাতেই মৌটুসী আবার টুনির কাছে হাজির হলো, তার হাতে আরেকটা কাগজ। টুনিকে বলল, “এই যে আরেকটা চিঠি পেয়েছি, বলতে পারবে এটা কে লিখেছে?”
“টুনি বলল, দেখি।”
মৌটুসী বলল, “এই চিঠিতে অনেক গালিগালাজ।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। এই দেখো।”
টুনি চিঠিটা হাতে নিল, এইটাও উল্টো করে লেখা, টুনি কাগজটা উল্টো করে আলোতে ধরে রেখে পড়ল,
মৌটুসী
সাবধান! তোমার কারণে ক্লাশে আমাদের কত কষ্ট। স্যার-ম্যাডামের বকাবকি শুনতে হয়। তাদের গালাগালি শুনতে হয়। তুমি এখনি সাবধান হয়ে যাও তা না হলে তোমার উপরে অনেক বিপদ। আমি তোমাকে ভয়ঙ্কর শাস্তি দিব। তুমি কী তাই চাও?
তোমার আজরাইল
টুনি চিঠিটা মৌটুসীকে ফেরত দিল। মৌটুসী বলল, “কে লিখেছে বলতে পারবে?”