টুনি বলল, “আপনার ভয়ে।”
নার্গিস ম্যাডাম অবাক হয়ে বললেন, “আমার ভয়ে?”
টুনি কোনো কথা না বলে এবারে নার্গিস ম্যাডামের স্যান্ডেলের দিকে তাকিয়ে রইল। নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “আমাকে তুমি ভয় পাও?”
টুনি মুখটা একটু ওপরে তুলে বলল, “সবাই ভয় পায়।”
“সবাই ভয় পায়?” নার্গিস ম্যাডাম অবাক হয়ে ক্লাশের দিকে তাকালেন, তাকে দেখে মনে হতে লাগল তিনি আশা করছেন সবাই এখন হা হা করে হেসে উঠবে তারপর মাথা নেড়ে বলবে, “না না আমরা ভয় পাই না! কেন ভয় পাব?”
কিন্তু কেউ সেটা বলল না। সবাই তার সামনের ছেলে কিংবা মেয়ের পিছনে মাথা লুকিয়ে ফেলল। একেবারে সামনের বেঞ্চে যারা আছে তাদের লুকানোর কেউ নাই, তাই তারা যতটুকু সম্ভব মাথা নিচু করে নিজের হাতের নখ কিংবা ডেস্কের উপর রাখা বাংলা বইটার দিকে তাকিয়ে রইল।
নার্গিস ম্যাডাম কেমন যেন হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর টুনির দিকে তাকালেন, বললেন, “কী আশ্চর্য! কেন ভয় পায়?”
টুনি নার্গিস ম্যাডামের চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে তার গলার লকেটের দিকে তাকিয়ে রইল, কোনো কথা বলল না। ম্যাডাম বললেন, “টুনি। তুমি ডিটেকটিভ, তুমিই বলো, কেন আমাকে সবাই ভয় পায়?”
টুনি টোক গিলে বলল, “বলব?”
“বলো।”
টুনি আরেকবার সেঁক গিলে বলল, “ভয় করছে ম্যাডাম।”
“ভয়ের কিছু নাই। বলো।”
টুনি মনে মনে একবার দোয়া ইউনুস পড়ে বুকে ফুঁ দিল তারপর বলল, “আপনাকে সবাই ভয় পায় কারণ আপনি কোনোদিন হাসেন না।”
সারা ক্লাশের মনে হলো যে তাদের উপর দিয়ে একটা টর্নেডো উড়ে গেল, সবার মনে হলো তারা সেই টর্নেডোতে উড়ে যাবে, সবকিছু ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই হলো না, নার্গিস ম্যাডাম কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর আস্তে আস্তে বললেন, “আমি হাসি না!”
নার্গিস ম্যাডাম কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন, সরাসরি তাকানোর সাহস নেই বলে সবাই চোখের কোনা দিয়ে নার্গিস ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে রইল। তারা অবাক হয়ে দেখল নার্গিস ম্যাডামের ঠোঁটের কোনায় একটা সূক্ষ্ম হাসি উঁকি দিচ্ছে। মনে হলো ম্যাডাম হাসিটা চেপে রাখার চেষ্টা করছেন কিন্তু চেপে রাখতে পারছেন না, ধীরে ধীরে তার সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ছে। তারপর সপ্তম আশ্চর্যের থেকেও বড় আশ্চর্য একটা ঘটনা ঘটে গেল। নার্গিস ম্যাডাম হঠাৎ ফিক করে একটু হেসে ফেললেন।
সারা ক্লাশ তখন একসাথে ফিক করে হেসে উঠল। ম্যাডাম তখন আরেকটু হাসলেন, ক্লাশের সবাই তখন আরেকটু হাসল। তারপর নার্গিস ম্যাডাম হাসতেই লাগলেন আর ক্লাশের সবাই হাসতে লাগল। টুনি শুধু অবাক হয়ে নার্গিস ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে রইল, ম্যাডাম যখন হাসেন তখন হঠাৎ করে তার সেই ভয়ঙ্কর চেহারাটা আর থাকে না, দেখে মনে হয় একেবারে স্বাভাবিক মানুষ।
নার্গিস ম্যাডাম তার হাসি থামালেন, ছেলে-মেয়েরা সাথে সাথে হাসি থামাল না, তারা আরো কিছুক্ষণ হাসল। ম্যাডাম তখন টেবিল থেকে খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে বললেন, “তোমরা সবাই টুনির উপর লেখাটা পড়েছ?”
যে ব্যাপারটা আগে কখনো ছেলেমেয়েরা কল্পনা করেনি সেটাই তারা করে ফেলল। কেউ কেউ চিৎকার করে বলল, “পড়েছি!” অন্যেরা আরো জোরে চিৎকার করে বলল, “পড়ি নাই!”
“ঠিক আছে, সবাই যেহেতু পড়ো নাই আমি তাহলে পড়ে শোনাই।” তারপর ম্যাডাম নিজে খবরের কাগজের লেখাটা পড়ে শোনালেন। ছেলে-মেয়েরা শুনল, মাঝে মাঝে হাততালি দিল, টেবিলে থাবা দিল, এমনকি কয়েকবার আনন্দে চিৎকার করে উঠল। দশ মিনিট আগে তারা সেটা করতে পারবে কল্পনা পর্যন্ত করেনি।
শুধু মৌটুসী পাথরের মতো মুখ করে বসে রইল।
.
এর পরে স্কুলে একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটে গেল। প্রথমে ক্লাশের ছেলে-মেয়েরা তারপর স্কুলের ছেলে-মেয়েরা ডিটেকটিভ টুনির কাছে তাদের সমস্যা নিয়ে আসতে শুরু করল। বিচিত্র তাদের সমস্যা! যেমন একজন এসে বলল :
“আমার গল্প বই পড়তে ভালো লাগে, আমার আব্দু-আম্মু আমাকে গল্প বই পড়তে দেয় না। কী করব?”
টুনি সমাধান দিল, “পাঠ্য বইয়ের নিচে গল্প বই রেখে পড়ে ফেলো।”
আরেকজন এসে বলল, “রাত্রে ঘুমাতে ভয় লাগে।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “কীসের ভয়?”
“ভূতের।”
টুনি একটা কাগজে লিখল :
৬ ১ ৮
৭ ৫ ৩
২ ৯ ৪
তারপর সেটা তাকে দিয়ে বলল, “এই কাগজটা ভাঁজ করে বালিশের নিচে রেখে ঘুমাবে।”
“এটা কী?”
“ম্যাজিক স্কয়ার। ভূত একটা জিনিসকে খুব ভয় পায়। সেটা হচ্ছে অংক। আর অংকের মাঝে সবচেয়ে বেশি ভয় ১৫ সংখ্যাটাকে। এই কাগজে যে সংখ্যা লেখা আছে সেটা যেভাবেই যোগ করবে ১৫ হবে। ভূত এটাকে খুব ভয় পায়। বালিশের নিচে রাখলে ভূতের বাবাও আসবে না!”
আরেকজন এসে বলল, “লেখাপড়া ভালো লাগে না।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “কেন?” “স্যার কী বলে বুঝি না।”
“কেন?”
“স্যার বোর্ডে কী লেখে সেইটাও দেখি না।”
টুনি কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের চশমাটা খুলে তাকে দিয়ে বলল, “এটা পরে দেখো তো কেমন লাগে।”
চশমা পরে সে অবাক হয়ে বলল, “আরে! সবকিছু স্পষ্ট–একেবারে ঝকঝক করছে।”
টুনি বলল, “তোমার চোখ খারাপ হয়েছে। আব্দু-আম্মুকে বলে চোখের ডাক্তারের কাছে গিয়ে চশমা নাও।”
আরেকজন এসে বলল, “সানজিদা আমার খাতার প্রথম পৃষ্ঠায় লিখেছে ‘পাগল।”