নার্গিস ম্যাডাম পড়াতে শুরু করলেন। ম্যাডাম বাংলা কবিতা পড়ান, এত সুন্দর কবিতা কিন্তু ছেলেমেয়েদের সেই কবিতা উপভোগ করার কোনো সুযোগ নেই, তারা নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে কখন কিছু একটা ভুল হয়ে যায় আর চোখের দৃষ্টি দিয়ে ম্যাডাম তাদের রক্ত শুষে নেন।
নার্গিস ম্যাডাম কবিতাটা পড়ে শোনাতে শোনাতে হঠাৎ একটা কাগজের খচমচ শব্দ শুনে তাকালেন এবং দেখতে পেলেন তৃতীয় বেঞ্চের মাঝামাঝি একটা ছাত্র একটা খবরের কাগজ খুব সাবধানে পিছনের বেঞ্চে পাচার করার চেষ্টা করছে। খবরের কাগজটিতে টুনির ছবি ছাপা হয়েছে এবং যে এখনো দেখেনি তার আর অপেক্ষা করার ধৈর্য ছিল না বলে নার্গিস ম্যাডামের ক্লাশেই এই ভয়ঙ্কর দুঃসাহসের কাজটি করে ফেলার চেষ্টা করেছিল।
নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “এই ছেলে তুমি কী করছ?”
নার্গিস ম্যাডাম মোটেও গলা উঁচিয়ে বলেননি, কিন্তু তবুও মনে হলো ক্লাশে বুঝি একটা বজ্রপাত হয়েছে। যে দুজন অপরাধী তাদেরকে নার্গিস ম্যাডাম দাঁড়াতে বলেননি কিন্তু দুজনই কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে গেল এবং দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগল। তাদের দুই পাশে যারা বসেছিল তারা যে কোনো মুহূর্তে বাথরুম হয়ে যেতে পারে আশঙ্কা করে দুই পাশে একটু সরে গেল।
নার্গিস ম্যাডাম খুবই শান্ত গলায় বললেন, “তোমাদের হাতে ওটা কী?”
একজন দুর্বলভাবে বলার চেষ্টা করল, “খ-খ-খ-” কিন্তু সে পুরো খবরের কাগজ বলে শেষ করতে পারল না। নার্গিস ম্যাডাম বরফের মতো শীতল আর চায়নিজ কুড়ালের মতো ধারালো চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন এবং দুইজনকে দেখে মনে হলো তারা বুঝি টুকরো টুকরো হয়ে খসে পড়তে শুরু করেছে।
নার্গিস ম্যাডাম বরফের মতো ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “কী আছে খবরের কাগজে? কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবর যে ক্লাশে বসেই পড়তে হবে?”
ছেলে দুটির একজন মাথা নেড়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। অন্যজন বলল, “টু-টু-টু” কিন্তু সেও কথা শেষ করতে পারল না। ক্লাশের সবাই বুঝে গেল সে টুনির নাম বলার চেষ্টা করছে। টেলিভিশনে টুনিকে দেখেই নার্গিস ম্যাডাম খুব বিরক্ত হয়েছিলেন, খবরের কাগজে তার ছবি দেখে ম্যাডাম কী করবেন সেটা চিন্তা করে সবাই শিউরে উঠতে লাগল। কেউ লক্ষ করল না বলে দেখতে পেল না শুধুমাত্র মৌটুসীর মুখে একটা আনন্দের ছায়া পড়ল।
নার্গিস ম্যাডাম হাত বাড়িয়ে বললেন, “খবরের কাগজটা দেখি।”
তৃতীয় বেঞ্চের ছেলেটা খবরের কাগজটা দ্বিতীয় বেঞ্চের ছেলেকে দিল, দ্বিতীয় বেঞ্চের ছেলেটা দিল প্রথম বেঞ্চের একজন মেয়েকে, সে সেটা দিল নার্গিস ম্যাডামকে। নার্গিস ম্যাডাম কাগজটা হাতে নিয়ে খুললেন, সাথে সাথে তার চোখ পড়ল টুনির বড় ছবিটাতে। তার চোখ বড় বড় হয়ে উঠল, মাথাটা একটু কাত করলেন (ভয়ে সারা ক্লাশের সবাই নিজেদের অজান্তে মাথা কাত করে ফেলল) তারপর পুরোটা পড়লেন। পড়ে মাথাটা সোজা করলেন। (সারা ক্লাশ মাথা সোজা করল) তারপর খবরের কাগজটা যত্ন করে ভাঁজ করে টেবিলের উপর রাখলেন।
ক্লাশের সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল, সবার বুক ভয়ে আতঙ্কে ধুকপুক করছে। যে দু’জন ছেলে দাঁড়িয়েছিল তারা তাদের হাঁটুতে আর জোর পাচ্ছে না, মনে হতে থাকে যে কোনো মুহূর্তে হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবে।
নার্গিস ম্যাডাম ডাকলেন, “টুনি।”
টুনি উঠে দাঁড়াল।
নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “আমি গতকালকে বলেছিলাম তোমার চাচার লেজ ধরে তোমার টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে যাওয়া উচিত হয়নি। মনে আছে?”
টুনি শুকনো গলায় বলল, “মনে আছে ম্যাডাম।”
“এখন দেখতে পাচ্ছি তুমি তোমার চাচার লেজ ধরে ক্যামেরার সামনে যাওনি, তুমি নিজের যোগ্যতাতেই গিয়েছ।”
টুনি একটু হকচকিয়ে গিয়ে নার্গিস ম্যাডামের দিকে তাকাল। আলোচনাটা কোন দিকে যাচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। এখন কি সে আগের থেকেও বড় অপরাধ করে ফেলেছে? কাজেই টুনি কিছু না বলে নার্গিস ম্যাডামের নাকের দিকে তাকিয়ে রইল।
নার্গিস ম্যাডাম শীতল গলায় বললেন, “এই পত্রিকার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে তোমার স্টচাই তোমার লেজ ধরে টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে গিয়েছেন। কথাটা কি ঠিক?”
টুনি গলাটা পরিষ্কার করে বলল, “আসলে আমরা কেউ টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে যাই নাই। পুলিশ ডিপার্টমেন্ট একটা অনুষ্ঠান করেছিল, সেখানে গিয়েছিলাম। অনেক সাংবাদিক ছিল। তার মাঝে টেলিভিশন ক্যামেরা ছিল।”
ক্লাশের ছেলেমেয়েরা হতবাক হয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, তারা কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না যে, টুনি সরাসরি নার্গিস ম্যাডামের সাথে কথা বলছে। টুনিকে তখন তাদের মনে হতে থাকে বিশাল সাহসী একটা বাঘের বাচ্চা! কিংবা কে জানে বাচ্চা নয়–আস্ত বাঘ!
“তুমি গতকাল আমাকে বিষয়টা বলো নাই কেন?” নার্গিস ম্যাডামের গলায় কিছু একটা ছিল যেটা শুনে সারা ক্লাশ কেমন যেন শিউরে উঠল।
টুনি কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করল। নার্গিস ম্যাডাম তার গলাটা আরেকটু উঁচু করে এবারে ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন বলো নাই?”
ক্লাশের বেশিরভাগ ছেলে-মেয়ে আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলল। টুনি একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “ভয়ে।”
নার্গিস ম্যাডামকে দেখে মনে হলো কথাটা শুনে খুব অবাক হয়েছেন। চোখ বড় বড় করে বললেন, “কীসের ভয়ে?”