টুনি মাথা নাড়ল, কোনো কথা বলল না। মৌটুসী তখন বলল, “যখন আমার গল্পটা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল তখন পত্রিকায় আমার ইন্টারভিউ ছাপা হয়েছিল।”
টুনি এবারেও মাথা নাড়ল, কোনো কথা বলল না। মৌটুসী বলল, “আমি যখন অলিম্পিয়াডে মেডেল পাই তখন আমাদের গ্রুপ ফটো তোলে, সেই গ্রুপ ফটো সব পত্রিকায় ছাপা হয়।”
টুনি আবার মাথা নাড়ল, এবারেও কোনো কথা বলল না। তখন মৌটুসী মনে হয় একটু রেগে গেল, রেগে গিয়ে বলল, “আমি তোমার মতো টেলিভিশনে নিজের চেহারা দেখাতে মামা-চাচাঁদের পিছনে ঘুরি না। টেলিভিশনের ক্যামেরা আমার কাছে আসে। বুঝেছ?”
টুনি সাধারণত রাগে না কিন্তু এবারে একটু রেগে গেল, কিন্তু সেটা প্রকাশ করল না। মৌটুসীর দিকে তাকিয়ে সে একটু হাসার ভঙ্গি করল।
মৌটুসী রেগে গিয়ে বলল, “তুমি আমার দিকে তাকিয়ে এভাবে হাসছ কেন?”
টুনি বলল, “তোমাকে দেখলে, তোমার কথা শুনলে আমার আনন্দ হয়, তাই আমি হাসি!”
মৌটুসী থতমত খেয়ে বলল, “আমাকে দেখলে আনন্দ হয়?”
টুনি মাথা নাড়ল। মৌটুসী জিজ্ঞেস করল, “কেন আনন্দ হয়?”
টুনি বলল, “তোমার চেহারা এত সুন্দর, তোমার এত গুণ সেই জন্যে।”
মৌটুসী এবারে হকচকিয়ে গেল, টুনি সত্যি বলছে না টিটকারি করছে সেটা সে বুঝতে পারল না, তাই হেঁটে হেঁটে চলে গেল।
টুনি একা একা চুপচাপ বসে থাকে, তার মনটা খুব খারাপ। সে ছোটাচ্চুর আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে জোর করে ঢুকে গিয়ে অনেক কিছু করেছে কথাটা সত্যি, কিন্তু সেগুলো সে করেছে তার করতে ভালো লাগে বলে। টেলিভিশনে তার চেহারা দেখাবে সেটা কখনো তার মাথাতেই আসেনি। এখন সবাই ভাবছে টেলিভিশনে চেহারা দেখানোর জন্য সে হ্যাংলার মতো ছোট চাচার পিছনে পিছনে তার লেজ ধরে ঘুরছে। কী লজ্জা! কী অপমান! কী দুঃখ! টুনির চোখে একেবারে পানি চলে আসছিল কিন্তু সে জোর করে চোখ থেকে পানি বের হতে দিল না। মুখটা শক্ত করে বসে রইল।
.
বাসাতে এসেও তার মনটা খারাপ হয়ে থাকল, সে এমনিতেই কথা কম বলে, সব সময় চুপচাপ থাকে, তাই বাসার কেউ সেটা টের পেল না। পরের দিন তার স্কুলে যেতেই ইচ্ছে করছিল না, যদি স্কুলে না যায়, সবাই কিন্তু একটা সন্দেহ করে বসে থাকবে, তাই সে স্কুলে গেল। স্কুলে এসেও সে তার নিজের সিটে চুপচাপ বসে রইল। আজকেও নার্গিস ম্যাডামের ক্লাশ আছে, আজকে ক্লাশে এসে নার্গিস ম্যাডাম কিছু একটা বলে ফেলবেন কি না সেটা নিয়েও তার ভেতরে একটা অশান্তি।
কিন্তু হঠাৎ করে সবকিছু অন্য রকম হয়ে গেল। ক্লাশ শুরু হওয়ার ঠিক আগে আগে ক্লাশের সবচেয়ে যে দুষ্ট ছেলে সে খুবই উত্তেজিতভাবে ক্লাশে ঢুকে বেঞ্চে নিজের বইয়ের ব্যাগটা রেখেই ছুটে টুনির কাছে এসে হাজির হলো। তার হাতে একটা পত্রিকা, পত্রিকাটা খুলে সে টুনিকে দেখিয়ে বলল, “টুনি! এই দ্যাখ!”
টুনি দেখল পত্রিকায় তার বিরাট একটা ছবি, চোখে চশমা, মুখে চাপা হাসি, হাতে কয়েকটা বই ধরে রেখেছে। ছবির নিচে বড় বড় করে লেখা ‘ক্ষুদে গোয়েন্দা’। তার নিচে একটু বড় বড় করে লেখা, কেমন করে ধরা হলো গাবড়া বাবা ওরফে গাল কাটা বকইর্যাকে। তার নিচে ছোট ছোট করে অনেক কিছু লেখা। যখন সবাই মিলে গাবড়া বাবাকে ধরে ফেলেছিল তখন মনে আছে একজন মানুষ অনেকক্ষণ টুনির সাথে কথা বলেছিল, তার অনেকগুলো ছবি তুলেছিল। সেই মানুষটা নিশ্চয়ই সাংবাদিক, সেই নিশ্চয় খবরটা পত্রিকায় ছাপিয়ে দিয়েছে। টুনির খুব ইচ্ছে করছিল পত্রিকায় কী লিখেছে পড়ে দেখে কিন্তু সবার সামনে সেটা করতে তার একটু লজ্জা লাগল। তাই সে পত্রিকাটা এক নজর দেখে চুপচাপ বসে রইল।
সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেটা বলল, “টুনি! তুই কোনোদিন আমাদেরকে বলিসনি তুই এত বড় ডিটেকটিভ!”
টুনি বলল, “আমি মোটেই বড় ডিটেকটিভ না।”
দুষ্টু ছেলেটা চিৎকার করে বলল, “বড় ডিটেকটিভ না হলে পত্রিকায় কোনোদিন এত বড় করে ছবি ছাপা হয়? মন্ত্রীদের ছবিও এত বড় করে ছাপা হয় না।”
দুষ্টু ছেলেটার চিৎকার শুনে অন্যেরাও তখন চলে এলো, তারাও পত্রিকার ছবিটা আর নিচের ক্যাপশানটা পড়ে চিৎকার করতে লাগল। আর সেই চিৎকার শুনে অন্যেরা এসে পত্রিকাটা দেখে আরো জোরে চিৎকার করতে লাগল, পত্রিকাটা ধরে কাড়াকাড়ি করতে লাগল। সবাই মিলে টুনিকে ঘিরে লাফাতে লাগল, পত্রিকায় কী লিখেছে সেটা একজন আরেকজনকে ধাক্কাধাক্কি করে, জোরে জোরে পড়তে লাগল। সবাই এলেও মৌটুসী এলো না, সে দূরে তার সিটে বসে রইল, টুনিকে ঘিরে যে এত হইচই, চিৎকার-চেঁচামেচি সেটা নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখাল না। টুনির বুঝতে বাকি রইল না যে হিংসায় মৌটুসীর বুকের ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছে। সে যখন কোনো মেডেল পায় তখন সে ক্লাশে এসে সেটা সবাইকে দেখানোর চেষ্টা করে, কেউ কোনোদিন সেটা ভালো করে দেখারও চেষ্টা করে না। কিন্তু আজ টুনিকে নিয়ে সবার কত আনন্দ, কত উত্তেজনা–তার হিংসা তো হতেই পারে।
ঠিক তখন ক্লাশের ঘণ্টা পড়ে গেল বলে টুনিকে ঘিরে উত্তেজনাটা আপাতত থেমে যেতে হলো।
নার্গিস ম্যাডাম যখন ক্লাশে ঢুকলেন তখন অন্যান্য প্রত্যেক দিনের মতো ক্লাশ একেবারে কবরের মতো নীরব হয়ে গেল। দেখে বোঝারও উপায় নেই ক্লাশে কোনো জীবিত মানুষ আছে, মনে হয় সবাই বুঝি নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেছে।