নার্গিস ম্যাডাম যখন ক্লাশে আসেন তখন ক্লাশের ছেলেমেয়েরা মাঝে মাঝে ভয়ে নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে যায়। শোনা যায়, নার্গিস ম্যাডাম যদি নিচু ক্লাশের কোনো ছেলের কিংবা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘এই ছেলে’ কিংবা ‘এই মেয়ে’ তাহলে নাকি তাদের কাপড়ে বাথরুম হয়ে যায়।
সেই ভয়ঙ্কর নার্গিস ম্যাডাম একদিন টুনিদের ক্লাশে এসে টুনির দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই মেয়ে!”
টুনি সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেল। নার্গিস ম্যাডামের দিকে সরাসরি তাকানোর সাহস কারো নেই, তাই টুনি তার নাকের দিকে তাকিয়ে বলল, “জি ম্যাডাম।”
সমস্ত ক্লাশ তখন নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে। নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “সেই দিন টেলিভিশনে দেখলাম একজন বড় সন্ত্রাসীকে ধরেছে বলে পুলিশ একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভকে পুরস্কার দিচ্ছে।”
টুনি ঢোক গিলে বলল, “জি ম্যাডাম।” গাবড়া বাবা সেজে থাকা গাল কাটা বকইর্যাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে পুলিশ থেকে ছোটাচ্চুকে একটা চেক দিয়েছিল, কয়েকটা টেলিভিশন চ্যানেলে সেটা দেখানো হয়েছিল, নার্গিস ম্যাডাম মনে হয় সেই অনুষ্ঠানটা দেখেছিলেন।
নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “তোমাকে দেখলাম সেই প্রাইভেট ডিটেকটিভের পাশে সাজুগুজু করে দাঁড়িয়ে ছিলে।” সাজুগুজু শব্দটা উচ্চারণ করার সময় একটা টিটকারির ভান করলেন আর সেটা শুনে সারা ক্লাশ শিউরে উঠল। টুনি ফ্যাকাসে মুখে বলল, “জি ম্যাডাম।”
নার্গিস ম্যাডাম তার ভ্রমরের মতো কালো চোখ বড় করে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন জানতে পারি?”
টুনি বলল, “প্রাইভেট ডিটেকটিভ হচ্ছেন আমার ছোট চাচা।”
“সেই জন্যে তুমি টেলিভিশন ক্যামেরায় নিজের চেহারা দেখানোর জন্যে সাজুগুজু করে তোমার ছোট চাচার লেজ ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে?”
সারা ক্লাশ আবার শিউরে উঠল। টুনি ভাবল একবার বলে, আসলে সে মোটেই সাজুগুজু করে ছোটাচ্চুর লেজ ধরে দাঁড়িয়ে ছিল না। পুলিশের লোকেরা কীভাবে জানি খবর পেয়েছিল যে টুনি গাবড়া বাবার চুল আর দাড়ি টেনে খুলে ফেলে তাকে ধরিয়ে দিয়েছিল, তাই তারাই ছোটাচ্চুর পাশে তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু নার্গিস ম্যাডামের মুখের উপর সেই কথা বলা সম্ভব না, তাই সে কোনো কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
নার্গিস ম্যাডাম তার ফুলের মতো ঠোঁটগুলো সাপের মতো বাঁকা করে বললেন, “শোনো মেয়ে, টেলিভিশনে চেহারা দেখানোর জন্যে অ জায়গায় কু-জায়গায় নিজের মাথা ঢুকিয়ে দেবে না। যদি কোনোদিন নিজের যোগ্যতায় টেলিভিশনে তোমার চেহারা দেখাতে পারো তাহলে ক্যামেরার সামনে যাবে। না হলে যাবে না। বুঝেছ?”
টুনি মাথা নেড়ে জানাল সে বুঝেছে।
নার্গিস ম্যাডাম তখন পুরো ক্লাশকে লক্ষ করে বললেন, “তোমাদেরকেও বলে রাখি। একজন মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে তার আত্মসম্মানবোধ। তোমরা কোনোদিন শুধুমাত্র টেলিভিশনের ক্যামেরায় নিজের চেহারা দেখানোর জন্যে এই আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দিবে না। যার আত্মসম্মানবোধ নাই তার কিছু নাই।” ‘কিছু নাই’ কথাটা এমনভাবে উচ্চারণ করলেন যে মনে হলো ক্লাশ রুমের ভেতর দিয়ে মেশিনগানের গুলি ছুটে গেল। সারা ক্লাশ আতঙ্কে শিউরে উঠল।
ক্লাশ শেষে নার্গিস ম্যাডাম চলে যাবার পর সবাই টুনির কাছে ছুটে এলো, সবাই জিজ্ঞেস করল সে ঠিক আছে কি না। একজন বলল, “বাসায় গিয়ে লবণ পানি খাবি। তারপর শুয়ে থাকবি।” আরেকজন বলল, “গরম পানি দিয়ে গোসল করে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বি।”
দুষ্টু টাইপের একজন বলল, “টেলিভিশনের ক্যামেরায় আমিও ঢুকে যাই। বই মেলায় গিয়ে আমি সব সময় ক্যামেরাম্যানদের পিছনে পিছনে হাঁটি। যখনই দেখি কারো ইন্টারভিউ নিচ্ছে তখনই পিছনে দাঁড়িয়ে যাই। একদিন আমাকে তিনটা চ্যানেলে দেখিয়েছিল!”
টুনি কিছু বলল না। সবাই ধরেই নিয়েছে টেলিভিশনে চেহারা দেখানোর জন্যে সে বুঝি জোর করে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে গেছে। কী লজ্জা! টুনির একবার মনে হলো সত্য কথাটা বলে দেয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলল না।
ক্লাশের ছেলেমেয়েরা চলে যাবার পর টুনির কাছে এলো তাদের ফাস্ট গার্ল মৌটুসী। মৌটুসী লেখাপড়ায় খুব ভালো, তার চেহারাও খুব ভালো, সে খুব ভালো কবিতা আবৃত্তি করতে পারে, নজরুলগীতির কম্পিটিশনে সে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, মৌটুসী কারাতে ক্লাশে ভর্তি হয়ে রেড বেল্ট পর্যন্ত গিয়েছে, স্কুলের স্পোর্টসে সে লংজাম্পে ফার্স্ট হয়েছে, গণিত আর পদার্থ বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে সে মেডেল পেয়েছে। স্কুলের শেষে সে নাচের ক্লাশে যায় নাচ শিখতে, সে সুন্দর ছবি আঁকতে পারে, গল্প লেখার কম্পিটিশনে সে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আর কম্পিটিশনের লোকেরা যে বই লিখেছে সেই বইয়ে তার গল্প ছাপা হয়েছে। এক কথায় একজন মেয়ের যা যা ভালো থাকার কথা মৌটুসীর তার সবকিছু আছে, কিন্তু তার একটা অনেক বড় সমস্যা আছে, সেটা হচ্ছে সে এক সেকেন্ডের জন্যেও ভুলতে পারে না যে সে রূপে-গুণে সবার থেকে ভালো! সে কারণে অহঙ্কারে তার মাটিতে পা পড়ে না আর তাই ক্লাশের কেউ তাকে দুই চোখে দেখতে পারে না। মৌটুসীর তাই ক্লাশে কোনো বন্ধু নেই, সে একা একা ঘুরে বেড়ায়।
আজকেও সে একা একা টুনির কাছে এলো। এসে বলল, “আমি যখন নজরুলগীতি কম্পিটিশনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম তখন আমাকে টেলিভিশনে দেখিয়েছিল।”