ঝুমু খালার বঁটা দেখে একজন বাচ্চা জিজ্ঞেস করল, “ঝুমু খালা, তুমি কেমন করে ঝাড় দিয়ে পিটাবে। ভূতকে তো দেখা যায় না।”
ঝুমু খালা বলল, “খালি চোখে দেখা যায় না। কলকের ভিতর দিয়ে তাকালে সব ভূত দেখা যায়।”
বাচ্চাদের বেশিরভাগই কলকে চিনে না, তাই ঝুমু খালাকে হুঁকো এবং কলকে ব্যাখ্যা করতে হলো। হুঁকো খাওয়ার বদলে মানুষজন সিগারেট খেয়ে যে পৃথিবীর কত বড় সর্বনাশ করে ফেলেছে ঝুমু খালা সেটা খুব জোর দিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে দিল।
একজন জিজ্ঞেস করল, “ঝুমু খালা, তুমি কখনো কলকের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে ভূত দেখেছ?”
“দেখি নাই আবার! একশ’ বার দেখেছি। একশ’ রকম ভূত দেখেছি।”
আরেকজন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “দেখতে কী রকম?” ঝুমু খালা হাত-পা নেড়ে বলল, “বেশিরভাগ ভূতের সাইজ হয় ছোট। তাদের ঘাড় নাই, ধড়ের উপর এই এত বড় মাথা। চোখগুলো লাল, নাক নাই, সেইখানে দুইটা গর্ত। মুখে মুলার মতন দাঁত, লম্বা জিব। হাত দুইটা হাঁটুর সমান লম্বা। দেখলে মনে হয় শরীর থেকে চামড়া তুলে নিয়েছে, সেইখানে আবার বিশ্রী গন্ধ। মড়া পোড়ালে যেরকম গন্ধ বের হয় সেইরকম।“
ঝুমু খালার বর্ণনা শুনে বেশিরভাগ বাচ্চার ভূত দেখার শখ মিটে গেল।
ভূতের বাড়ি যাবার জন্যে অনেকেই রেডি হয়ে থাকলেও যখন যাবার সময় হলো তখন তাদের সংখ্যা কমতে শুরু করল। যারা বেশি ছোট তাদের আম্মুরা ভেটো দিয়ে দিল। দেখা গেল অনেকেরই পরের দিন পরীক্ষা। সবচেয়ে উৎসাহী একজনের হঠাৎ করে একশ’ তিন ডিগ্রি জ্বর উঠে গেল। একজনের পরের দিন তার প্রাণের বন্ধুর জন্মদিন, সেই জন্মদিনে না গেলে প্রাণের বন্ধুর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে, তাই তার ভূতের বাড়ি যাবার আশা ছেড়ে দিতে হলো। তার দেখাদেখি অন্য কয়েকজনও ঠিক করল তারাও যাবে না। ভূতের বাড়িতে টেলিভিশন নাও থাকতে পারে আশঙ্কা করে টেলিভিশনের পোকা দুইজন পিছিয়ে গেল। তাদের দেখাদেখি অন্য দুইজন। কয়েকজন কোনো কারণ না দেখিয়ে পিছিয়ে গেল, তারা মুখে কিছু না বললেও অনুমান করা গেল ঝুমু খালার ভূতের বর্ণনা শুনে তারা যাবার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে!
কাজেই পরের দিন যখন একটা মাইক্রোবাস সবাইকে ভূতের বাড়ি নিয়ে যেতে হাজির হয়েছে তখন মানুষজন খুবই কম। ছোটাচ্চু, শান্ত, টুনি এবং টুম্পা, তাদের সাথে ঝুমু খালা। ছোটাচ্চুর গলায় একটা বড় তাবিজ, সেটা ছোটাচ্চু লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু কালো সুতার কারণে বেশ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। ঝুমু খালা তার প্রিয় ঝাঁটাটা নিয়ে রওনা দিতে চেয়েছিল কিন্তু তাকে বোঝানো গিয়েছে ভূতের বাড়িতে গিয়েও একটা বঁটা পাওয়া যাবে। শান্ত একটা ক্রিকেট ব্যাট নিয়েছে–মোটেও ক্রিকেট খেলার জন্যে নয়–অস্ত্র হিসেবে। ক্রিকেট ব্যাটকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায় কি না সেটা নিয়ে এখন কোনো প্রশ্ন করা হয়নি। টুনির ব্যাগে ঘুমের কাপড়, টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, সাবান, তোয়ালে, নোট বই ছাড়াও আরো কিছু মাল-মসলা আছে, যেটা এখনো কেউ জানে না। সে আগের দিন বাজারে ঘোরাঘুরি করে সংগ্রহ করেছে। টুম্পা একটা মোটা গল্পের বই নিয়েছে, টুনির উপরে তার অনেক বিশ্বাস–টুনি বলেছে গল্প বই ছাড়া আর কিছুই নেবার দরকার নেই।
মাইক্রোবাসে ওঠার সময় শান্ত সবার আগে লাফিয়ে সামনের সবচেয়ে ভালো সিটটাতে বসে গেল। তার পাশে বসল ছোটাচ্চু। পিছনের সিটে টুনি আর টুম্পা। ঝুমু খালা ড্রাইভারের পাশের সিটে। মাইক্রোবাসটা ছাড়ার সময় ড্রাইভার খুব সন্দেহের চোখে ঝুমু খালাকে একনজর দেখে নিল, ঝুমু খালা তার চাইতেও বেশি সন্দেহের চোখে ড্রাইভারকে কয়েক নজর দেখে নিল!
মাইক্রোবাসটা ছেড়ে দেবার সাথে সাথে বোঝা গেল ড্রাইভার খুব বেশি কথা বলে। একজন যখন কথা বলে তখন অন্যদের সেই কথাটা শোনার কথা, প্রথমে কিছুক্ষণ তাই সবাই ড্রাইভারের কথা শোনার চেষ্টা করল কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই তারা হাল ছেড়ে দিল। তার কারণ ড্রাইভার গাড়ি ড্রাইভিং নিয়ে তার আলোচনাটা শুরু করল এইভাবে, “যখন ট্রেনে মানুষ কাটা পড়ে তখন কি ট্রেনের ড্রাইভারের নামে মামলা হয়? হয় না। তাহলে যখন মানুষ গাড়ির নিচে চাপা পড়ে তখন গাড়ির ড্রাইভারের নামে মামলা কেন হয়? কী যুক্তি? কোনো যুক্তি নাই। গাড়ির ড্রাইভারের নামে মামলা দেয়া ঠিক না। একজন ড্রাইভার যখন গাড়ি চালায় তখন সে কয়দিক দেখবে? রাস্তার মাঝে কি খালি গাড়ি? না। রিকশা, টেম্পু, পাবলিক, গরু-ছাগল কি নাই? আমি আজ পনেরো বছর থেকে গাড়ি চালাই, আমি কি দেখেছি জানেন? গরু-ছাগলের বুদ্ধি পাবলিক থেকে বেশি। কোনোদিন শুনেছেন গাড়ি একসিডেন্টে গরু মরেছে? ছাগল মরেছে? শুনেন নাই। তার কারণ গরু-ছাগলের বুদ্ধি পাবলিক থেকে বেশি, তারা গাড়ির নিচে চাপা খায় না। পাবলিক রেগুলার চাপা খায়। দোষ হয় ড্রাইভারের। পৃথিবীতে কোনো ইনসাফ নাই। কোনো বিচার নাই। দেশের সব ড্রাইভার মিলে আন্দোলন করা দরকার, প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করা দরকার, গাড়ির ড্রাইভারদের ট্রেনের ড্রাইভারের সমান মর্যাদা দিতে হবে। গাড়ির একসিডেন্ট হলে গাড়ির ড্রাইভারদের কোনো দায়-দায়িত্ব নাই। তাদের নামে মামলা করা যাবে না। পাবলিক পিটা দিতে পারবে না–”