ছোটাচ্চু তার অন্ধকার মুখ নিয়ে বলল, ‘পা-পা-পাকা করে ফেলেছ?”
“হ্যাঁ। পরশু দিন একটা এসি মাইক্রোবাসে তোমার টিমকে নিয়ে যাবে। পরের দিন আবার নিয়ে আসবে। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ওই পার্টির।”
ছোটাচ্চুর মুখটা আরো অন্ধকার হয়ে গেল। ফারিহা বলল, “আমি কোনো কাঁচা কাজ করি না। বলেছি, অর্ধেক এডভান্স করতে হবে, এক কথায় রাজি। চেক লিখে মেল করে দিয়েছে। কালকে পেয়ে যাবে।”
বেশ কিছুক্ষণ থেকে ছোটাচ্চু কথা বলার চেষ্টা করছিল, ফারিহা সুযোগ দিচ্ছিল না, এবারে একটু চেষ্টা করে বলল, “ওই লোক তোমার খোঁজ পেল কেমন করে?”
ফারিহা কথাটাকে খুব গুরুত্ব দিল না, হাত দিয়ে উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, “মনে হয় জানে তোমার সাথে আমার পরিচয় আছে। সেই জন্যে আমাকে মিসড কল দিয়েছে।”
“মিসড কল? এত বড় একটা ক্লায়েন্ট মিসড কল দেয়?”
“আরে মিসড কল হচ্ছে একটা কালচার। বড়-ছোটর সাথে এর কোনো সম্পর্ক নাই!”
ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ মুখটা অন্ধকার করে বসে থাকল, তারপর ফোঁস করে একটা বিশাল নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এই পার্টি আগে আমাকে ফোন করেছিল।”
“সত্যি?” ফারিহা অবাক হবার একটা অসাধারণ অভিনয় করল।
“হ্যাঁ।” ছোটাচ্চু বলল, “আমি তাঁকে পরিষ্কার না করে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম-”
“কী বলেছিলে?”
“বলেছিলাম লাখ টাকা দিলেও এই ভূতের কেস নিব না।”
ফারিহা মধুর ভঙ্গি করেহাঁসল, বলল, “তুমি তোমার কথা রেখেছ। পার্টি লাখ টাকা দিবে না–অনেক কম দিবে!”
ছোটাচ্চু কেমন যেন ঘোলা চোখে ফারিহার দিকে তাকিয়ে রইল।
.
সন্ধ্যেবেলা টুনি ছোটাকে দেখতে তার ঘরে গেল। ছোটাচ্চু তার বিছানায় পা ভাঁজ করে বসে আছে, মুখ দেখে মনে হচ্ছে এই মাত্র খবর পেয়েছে যে তার যাবজ্জীবন জেল হয়ে গেছে। টুনিকে দেখে চি চি করে বলল, “টুনি।”
টুনি বলল, “কী হয়েছে ছোটাচ্চু?”
“খুবই খারাপ খবর।”
খারাপ খবর শুনলে চোখে-মুখে যে রকম ভাব করার কথা টুনি সে রকম ভাব করে বলল, “কী খারাপ খবর ছোটাচ্চু?”
“ফারিহা আমাকে খুব বিপদে ফেলে দিয়েছে।”
“ফারিহাপু? বিপদে? তোমাকে?”
“হ্যাঁ। একটা কেস নিয়ে নিয়েছে আমাকে জিজ্ঞেস না করে। আমি করে দিয়েছিলাম।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী কেস ছোটাচ্চু?”
“একটা ভূতের বাড়ি চেক করে দেখতে হবে সত্যি না মিথ্যা।”
“নিশ্চয়ই মিথ্যা ছোটাচ্চু। সত্যি সত্যি তো আর ভূত নাই।”
“যদি থাকে? বুঝলি তো–এই ভূত-প্রেত, জীন-পরী আমার খুব খারাপ লাগে।”
টুনি কোনো কথা বলল না। ছোটাচ্চু বলল, “যদি সত্যি সত্যি ভূত কিছু একটা করে ফেলে?”
“ভূত থাকলে নিশ্চয়ই ভূতের ওষুধও আছে।”
ছোটাচ্চু জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “আমিও তাই বলছিলাম। ভূতের তাবিজ-কবজ নিশ্চয়ই আছে। আছে না?”
টুনি কী আর করবে, মাথা নাড়ল। ছোটাচ্চু বলল, “আমি তাই ভাবছিলাম খামাখা রিস্ক নিয়ে লাভ কী? একটা পীর-ফকিরকে খুঁজে বের করে একটা তাবিজ নিয়ে ফেলি কী বলিস? যেতেই যখন হবে একটু সাবধানে যাই।”
টুনি আবার মাথা নাড়ল। ছোটাচ্চু চি চি করে বলল, “মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ভূত তড়ানোর দোয়া-দরুদ জানে কি না।”
“দাদু কী বলেছে?”
“মা বলেছে আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকে ফুঁ দিলে ভূত ধারে-কাছে। আসতে পারে না।”
“তাহলে আয়াতুল কুরসিটা মুখস্থ করে ফেলো।”
ছোটাচ্চু মুখ শুকনো করে বলল, “চেষ্টা করে দেখেছি, মুখস্থ হতে চায় না।”
“তোমার ফোনে রেকর্ড করা যায় না? ফোনে রেকর্ড করে নাও, যখন দরকার পড়বে চালিয়ে দেবে।”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “আইডিয়াটা খারাপ না।”
.
এর আগে ছোটাচ্চু যতবার তার ডিটেকটিভ কাজকর্ম করেছে ততবার বাচ্চা-কাচ্চাদের একশ হাত দূরে রেখেছে, কাউকে ধারে কাছে আসতে দেয়নি। এই প্রথমবার দেখা গেল ছোটাচ্চু সবাইকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে খুব ব্যস্ত। যেই যেতে চাইছে তাকেই ছোটাচ্চু নিয়ে যেতে রাজি হয়ে যাচ্ছে। এতজন বাচ্চা-কাচ্চাকে ছোটাচ্চু কেমন করে নিয়ে যাবে টুনি বুঝতে পারল না, সবাইকে নিতে হলে একটা মাইক্রোবাসে হবে না, একটা ডাবল ডেকার বাস লাগবে। বাচ্চা কাচ্চাদের আব্দু-আম্মুরা নিজেদের বাসায় বাচ্চা-কাচ্চাদের ভালো-মন্দ নিয়ে মাথা ঘামায় না কিন্তু এবারের ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। অন্য কারো বাসাতে সবাই রাত কাটাবে, কোথায় ঘুমাবে, কী খাবে–এই সব নিয়ে তারা দুশ্চিন্তা করতে লাগল। এই বাসায় তাদেরকে কেউ দেখে রাখে না, তার দরকার হয় না, কিন্তু সেই ভূতের বাড়িতে একজন বড় মানুষ দেখে না রাখলে বাচ্চা-কাচ্চাগুলো কী পাগলামো করে ফেলবে সেটা নিয়ে তাদের আব্দু-আম্মুরা চিন্তায় পড়ে গেল।
ঝুমু খালা তার সমাধান করে দিল। সবাই মিলে ভূতের বাড়ি যাচ্ছে শুনে সে একটা ঝাটা হাতে নিয়ে বলল সে সাথে যাবে আর এই ঝাঁটা দিয়ে পিটিয়ে ভূতের গুষ্টিকে নির্বংশ করে দিবে। সাথে ঝুমু খালা থাকবে শুনে বাচ্চা-কাচ্চাদের আম্মু-আব্বুরা নিশ্চিন্ত হয়ে গেল–তার মতো কাজের মানুষ এই বাসায় আর কেউ নেই।
ঝুমু খালার এই বাসায় সপ্তাহখানেক থেকে তার নিজের বাড়িতে ফিরে যাবার কথা ছিল কি দাদির সাথে তার একধরনের বন্ধুত্ব হয়ে যাবার জন্যে সে আর ফিরে যায়নি। সন্ধ্যার পর দাদির পায়ের কাছে বসে সে রসুন দেওয়া গরম সরিষার তেল দাদির পায়ে ডলে ডলে লাগাতে লাগাতে বাংলা সিরিয়াল দেখে এবং দুইজনে মিলে সিরিয়ালের যত চরিত্র আছে তাদের সমালোচনা করে। দাদি এবং ঝুমু খালার কথা শুনে মনে হতে পারে টেলিভিশনে বাংলা সিরিয়ালের চরিত্রগুলো সত্যিকারের মানুষ। রসুন দেওয়া সরিষার তেল মাখানোর কারণে দাদির শরীর থেকে এখন সবসময় কেমন যেন একধরনের কাবাবের গন্ধ বের হয়, দাদির অবশ্যি সেটা নিয়ে মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।