- বইয়ের নামঃ আরো টুনটুনি ও আরো ছোটাচ্চু
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ পার্ল পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
১. মারদানা ম্যাডাম
উৎসর্গ
কয়েক বছর আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ জননী জাহানারা ইমাম হলের ছাত্রীরা কারাটে শিখতে শুরু করেছিল। আমি তখন বলেছিলাম তাদের ভেতর যে প্রথম ব্ল্যাক বেল্ট হতে পারবে তাকে আমি একটা বই উৎসর্গ করব। (বই উৎসর্গ করানোর দ্বিতীয় আরো একটা পদ্ধতি ছিল কিন্তু সেটা প্রকাশ্যে বলা যাবে না!) আমার ঘোষণার কারণেই কি না জানি না, একজন নয় দুইজন নয়-নয় নয়জন ছাত্রী একসাথে ব্ল্যাক বেল্ট পেয়েছে।
কাজেই আমি আমার কথা রেখে এই বইটি এই নয়জন ব্ল্যাক বেল্টধারী ছাত্রীদের উৎসর্গ করছি। তারা হচ্ছে :
ঝুমুর দেব, ফারহানা ফেরদৌস শিউলী, আমিনা সুলতানা, জয়তি দত্ত, লাকী বেগম, শারমিন সুলতানা কণা, উম্মে মরিয়ম মৌসুমী, সাবিহা তাসনিম জেসি, সাথী রানী শর্মা
.
টুনটুনি ও ছোটাচ্চু ধারাবাহিকভাবে কিশোর আলোতে প্রকাশিত হচ্ছিল, লেখা শেষ হবার পর সেটি এই নামে একটা বই হিসেবেও প্রকাশিত হয়েছে। আমি লেখা শেষ করলেও কিনোর আলোর পাঠকেরা সেটা কিছুতেই মেনে নিতে রাজি হয়নি, বলা যায় তাদের প্রবল চাপের কারণে আমাকে আবার লিখতে শুরু করতে হয়েছিল-সকল চাপকে উপেক্ষা করা যায়, ভালোবাসার চাপ উপেক্ষা করা কঠিন।
আরো টুনটুনি ও আরো ছোটাচ্চু নাম দিয়ে এই বইটি প্রকাশ করার সময় বইয়ের শেষে নতুন একটি অংশ লিখে সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে-যেটুকু লিখেছিলাম সেটা পড়ে কেমন জানি অসম্পূর্ণ মনে হচ্ছিল।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
১ আগস্ট, ২০১৪
.
০১.
টুনিদের স্কুলের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ম্যাডামের নাম মারদানা ম্যাডাম। মহিলাদের গোঁফ থাকার কথা না কিন্তু টুনিদের স্কুলে বলাবলি করা হয় যে মারদানা ম্যাডামের গোঁফ আছে। কথাটা শুনে অনেকেই ভুরু কুঁচকাতে পারে, একজন মানুষের গোঁফ আছে কি নেই সেটা নিয়ে বলাবলি করার কী আছে? তার মুখের দিকে তাকালেই তো সেটা দেখা যাবে। কিন্তু আসলে তার মুখের দিকে তাকালে সেটা বোঝা যায় না, তার কারণ মারদানা ম্যাডামের গায়ের রং কুচকুচে কালো এবং তার গোঁফ যদি আসলেই থেকে থাকে সেটার রংও কুচকুচে কালো, তাই সেটা আলাদা করে দেখা যায় না। খুব কাছে গেলে অবশ্যই সেটা দেখা যাবে, কিন্তু কার ঘাড়ে দুইটা মাথা আছে যে মারদানা ম্যাডামের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করবে তার গোঁফ আছে কি নেই! যে সমস্ত ছেলেমেয়েদেরকে মারদানা ম্যাডাম কাঁচা চিবিয়ে খেয়েছেন (ঠিক আক্ষরিক অর্থে না, ভয়ঙ্কর শাস্তি দেওয়ার অর্থে) তারা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেছে যে মারদানা ম্যাডামের নাকের নিচে ঝাঁটার মতো কালো গোঁফ। তারা আরো বলেছে যে তার চোখের মাঝে মোটা হয়ে থাকা লাল লাল রক্তনালি–সেগুলো নাকি দপদপ করে কাঁপে এবং তার মুখে নাকি মাংসাশি প্রাণীর মতো গন্ধ। যাই হোক এর সবগুলো পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব না, কাজেই কেউ কখনো এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করার চেষ্টা করেনি। টুনিদের ক্লাশ মনিটর বলেছে মানুষ যখন বুড়ো হয় তখন নাকি সবার আগে গোঁফ পাকতে শুরু করে, কাজেই যদি সত্যি সত্যি মারদানা ম্যাডামের গোঁফ থেকে থাকে তাহলে আর কয়েক বছরের ভেতর সেগুলো পেকে সাদা হয়ে যাবে, তখন তার কুচকুচে কালো রঙের মাঝে সাদা গোঁফ খুব স্পষ্টভাবে দেখা যাবে। তখন সব বিতর্ক বন্ধ হয়ে যাবে।
এই যে ভয়ঙ্কর মারদানা ম্যাডাম তার থেকেও ভয়ঙ্কর স্যার হচ্ছে মতিউর স্যার। এই স্যার নিয়েও স্কুলে নানা রকম গুজব চালু আছে। যে গুজবটা সবচেয়ে বেশি চালু সেটা হচ্ছে উনিশ শ’ একাত্তর সালে মতিউর স্যার রাজাকার কমান্ডার ছিল, দেশ স্বাধীন হলে গ্রামের মানুষেরা ধরে তার কান কেটে দিয়েছে। মতিউর স্যারের ডান কানটা নাকি রাবারের তৈরি, প্রত্যেক দিন সকালে স্কুলে আসার সময় সুপার গ্লু দিয়ে কানটা নাকি লাগিয়ে নেয়। বিষয়টা পরীক্ষা করা খুব সোজা, ডান কানটা ধরে একটা হঁচকা টান দিলেই সেটা নিশ্চয়ই খুলে আসবে কিন্তু সেটা কে করবে? তবে শোনা যায় পাস করে বের হয়ে গেছে এরকম একজন ছাত্রী নাকি কিরা কেটে বলেছে যে মতিউর স্যার একবার খুব জোরে হাঁচি দিয়েছিল তখন তার ডান কানটা খুলে এসেছিল–সে সেটা নিজের চোখে দেখেছিল। সত্যি সত্যি কথাটা কে বলেছে সেটা অবশ্যি কখনোই প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। মতিউর স্যারের অনেকগুলো বেত আছে, একটা শিলং থেকে আনা হয়েছে, একটা বান্দরবানের, আরেকটা নেত্রকোনার। সরকার থেকে বেত মারা নিষেধ করে দেওয়ার পর মতিউর স্যারের মনের দুঃখে প্রায় হার্ট এটাকের মতো অবস্থা হয়েছিল। মতিউর স্যার এখনো মাঝে মাঝে ক্লাশে বেতগুলো নিয়ে আসে, বাতাসে শপাং শপাং করে মারে আর ছাত্রছাত্রীদের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যেহেতু বেত মারতে পারে না তাই গালিগালাজ করে মনের ঝাল মেটায়। তার গালির মতো বিষাক্ত গালি পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। যাকে একবার স্যার গালি দেয় কমপক্ষে এক মাস তার মন-মেজাজ খারাপ থাকে।
এই যে ভয়ঙ্কর মতিউর স্যার তার থেকেও ভয়ঙ্কর হচ্ছে নার্গিস ম্যাডাম! কথাটা শুনে সবাই মনে করতে পারে নার্গিস ম্যাডাম বুঝি দেখতে মারদানা ম্যাডাম আর মতিউর স্যার থেকেও ভয়ঙ্কর। কিন্তু আসলে সেটা সত্যি নয়, নার্গিস ম্যাডাম দেখতে অসাধারণ। দূর থেকে তাকে দেখলে মনে হয় সিনেমার নায়িকা, শুকনো পাতলা ছিপছিপে, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, চুলগুলো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে রাখা, সেখানে বেলী ফুলের মালা, পরনে আকাশী-নীল তাঁতের শাড়ি। কথাবার্তা শুনলে মনে হয় ইন্ডিয়ান বাংলা সিরিয়ালের নায়িকা কথা বলছে। কিন্তু যারা তাকে চিনে তারা সবাই জানে নার্গিস ম্যাডাম হচ্ছে ভয়ঙ্কর থেকেও ভয়ঙ্কর। শুধু চোখের দৃষ্টি দিয়ে নার্গিস ম্যাডাম যে কোনো ছাত্র কিংবা ছাত্রীর শরীরের সব রক্ত শুষে নিতে পারেন। একবার নাকি ক্লাশ নাইনের একজন ছাত্রীর দিকে নার্গিস ম্যাডাম তিরিশ সেকেন্ড কোনো কথা না বলে তাকিয়ে ছিলেন, সেই ছাত্রী বাসাতে গিয়েই অসুস্থ হয়ে পড়ল। হাসপাতালে গিয়ে তাকে দুই ব্যাগ এ পজিটিভ রক্ত দিতে হয়েছিল!