মনে হলো পুরো ব্যাপারটার মজার বিষয়টা সেও ধরে ফেলেছে এবং সেও একটু হেসে ফেলল। টুনি বলল, “তোমার মাথায় অনেক বুদ্ধি। কিন্তু আমার আরো বেশি বুদ্ধি। ঠিক কি না?”
গুল্লু মাথা নাড়বে কি না বুঝতে পারল না, শেষে অনিশ্চিতের মতো মাথা নেড়ে স্বীকার করে নিল।
টুনি বলল, “কাছে আসো। বসো। আমি তোমাকে কিছু করব না।”
গুল্লু এবারে টুনির কথা বিশ্বাস করে কাছে এসে দাঁড়াল। টুনি বেঞ্চের ফাঁকা জায়গাটা দেখিয়ে বলল, “বসো।”
গুল্লু বসল। টুনি আর টুম্পার পা কে কুকুরটা গুল্লুর পায়ের কাছে গুঁড়ি মেরে বসে। কুকুরটা কীভাবে জানি বুঝে গেছে এখানে কোনো বিপদ নেই। সে বেশ আরামে মাথাটা মাটিতে রেখে চোখ বন্ধ করল।
টুনি জিজ্ঞেস করল, “তোমার বাবা কী করে?”
গুল্লু বলল, “নাই।”
“মা?”
“জানি না।”
“জানো না?”
গুল্লু মাথা নাড়ল, বলল, “বাড়িতে ছিল।”
“তুমি বাড়ি যাও না?”
গুল্লু মাথা নেড়ে জানাল সে বাড়ি যায় না। টুনি জিজ্ঞেস করল, “থাকো কোথায়?”
গুল্লু হাত নেড়ে বলল, “এই তো।”
“খাও কোথায়?”
“হোটেলে। কাম করলে খাইতে দেয়।”
“কী কাজ?”
“কাটাকাটি, ধোয়াধুয়ি।”
টুনি বুঝতে পারল আলাপটা খুব ভালো এগুচ্ছে না। তাই অন্যভাবে চেষ্টা করল। কুকুরটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কুকুরের নাম কী?”
“বাঘা।” বাঘা নিজের নাম শুনে চোখ খুলে তাকিয়ে একবার লেজ নেড়ে আবার চোখ বন্ধ করল।
“বাঘা তোমার বন্ধু?”
গুল্লু মাথা নাড়ল, দাঁত বের করে হাসল, বলল, “এখন কেউ আমার টেকা নিতে পারে না।”
“তোমার অনেক টাকা?”
গুল্লু লাজুক মুখে একটু হাসার চেষ্টা করল, তারপর কোমরে গুঁজে রাখা একটা টাকার বান্ডিল বের করে গুনতে শুরু করল। টুনি একটু পরেই বুঝতে পারল সে গুনতে পারে না, একটু পরে পরেই গুল্লুর হিসাব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
টুম্পা বলল, “আমার কাছে দাও, আমি গুনে দিই।”
গুল্লু প্রথমে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে টুম্পার দিকে তাকাল, তার চেহারা দেখে মনে হলো সে তার জীবনে এ রকম আজগুবি কথা শুনে নাই। তার টাকা আরেকজনের হাতে তুলে দিবে গোনার জন্যে? কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে টাকার বান্ডিলটা টুম্পার হাতে তুলে দিল-টুম্পা টাকাগুলো গুনে বান্ডিলটা ফেরত দিয়ে বলল, “তিনশ বাহান্নো টাকা।”
“পাঁচশ হতে আর কত বাকি?”
টুম্পা হিসেব করে বলল, “একশ আটচল্লিশ।”
গুল্লু মুখ সুচালো করে শিস দেওয়ার মতো শব্দ করল। টুনি জিজ্ঞেস করল, “পাঁচশ টাকা তোমার কেন দরকার?”
গুল্লু টাকার বান্ডিলটা তার কোমরে খুঁজতে খুঁজতে বলল, “একটা বিজনেস শুরু করুম।”
“কীসের বিজনেস?”
“চা-গরম। ফেলাক্সে গরম পানি আর চায়ের কাপ দিয়া বিজনেস। মেলা লাভ।”
টুনি মোটামুটি হিংসার চোখে এই বিজনেসম্যানের দিকে তাকিয়ে রইল।
.
বাসায় ফিরে আসতে আসতে টুনি বলল, “আমাদের গরম পানি রাখার
একটা বড় ফ্লাস্ক আছে না?”
টুম্পা মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ, শান্ত ভাইয়ের জন্মদিনের সময় কিনেছিল।”
“এটা কোনো কাজে লাগে?”
“না।“
“এইটা আমরা গুল্লুকে দিয়ে দেই না কেন?”
টুম্পা মাথা নাড়ল, “তুমি দিতে পারবে না। ঝুমু খালা দিতে দিবে না। ঝুমু খালা বাসার সব জিনিস আটকে রাখে।”
টুনি বলল, “তুই সেটা আমার উপর ছেড়ে দে!”
টুম্পা হাসি হাসি মুখে বলল, “তাহলে অবশ্যি অন্য কথা। তোমার বুদ্ধির সাথে কেউ পারবে না!”
পরদিন সকালে টুনি রান্নাঘরে গিয়ে ঝুমু খালাকে বলল, “ঝুমু খালা, তুমি একটু সরো দেখি আমি পানি গরম করব।”
ঝুমু খালা চোখ কপালে তুলে বলল, “ছোট মানুষ রান্নাঘরে কেন? যাও বের হও।”
“কিন্তু আমার গরম পানি লাগবে।”
“আমি গরম করে দিব। তুমি বের হও।”
টুনি বলল, “কিন্তু ঝুমু খালা, আমার একটু পরে পরে লাগবে।”
“একটু পরে পরে? কেন?”
“আমি একটা সায়েন্স প্রজেক্ট করছি। স্কুলে নিতে হবে। একটা বোতলের মুখে একটা বেলুন লাগিয়ে বোতলটা যদি গরম পানিতে রাখো তাহলে বেলুনটা ফুলে ওঠে। কী হয় জানো তো? বোতলের ভিতরে যে বাতাস আছে–”
ঝুমু খালা টুনিকে থামিয়ে বলল, “আমার এত সাইন্স জানার দরকার নাই। যেইটুকু জানি তার যন্ত্রণাতেই বাঁচি না। রান্নাঘরের আগুনের মাঝে তোমার থাকার দরকার নাই, বের হও।”
“তাহলে আমার গরম পানি?”
“আমি কেতলিতে গরম করে দিব।”
“একটু পরে পরে গরম করে দিবে?”
ঝুমু খালা যখন সমস্যাটা সমাধান করার জন্যে চিন্তা করছে তখন টুনি তার মাথায় হঠাৎ করে বুদ্ধি আসার অনবদ্য অভিনয় করে বলল, “তার চাইতে একটা কাজ করলে কেমন হয়?”
“কী কাজ?”
“কেতলিতে পানি গরম করে তুমি বড় যে ফ্লাস্কটা আছে তার মাঝে রাখো, আমার যখন দরকার হবে তুমি ফ্লাস্কটা থেকে বের করে দিবে।”
ঝুমু খালা একটু চিন্তা করে বলল, “ঠিক আছে।”
তারপর তার অভ্যাসমতো একটু শাসন করে বলল, “এর পরে যখন সাইন্স পজিক করবা ঠান্ডা পানি দিয়া করবা, বুঝছ?”
টুনি বলল, “ঠিক আছে। আর শব্দটা সাইন্স পজিক না। সায়েন্স প্রজেক্ট।”
ঝুমু খালা ঝংকার দিল, “আমার এত কিছু জানার দরকার নাই। বিদায় হও।”
টুনি তখন খুব আনন্দের সাথে বিদায় হলো। তারপর টুম্পাকে খুঁজে বের করে তাকে ফিসফিস করে বলল, “আমি যখন বলব তখন ঝুমু খালাকে তুই রান্নাঘর থেকে বের করে নিয়ে যাবি, কিছুক্ষণ আটকে রাখবি। ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে।” টুনির উপর টুম্পার অগাধ বিশ্বাস, যখন সে ঝুমু খালাকে আটকে রাখবে তখন টুনি কী করবে সেটা জানতে পর্যন্ত চাইল না।