টুনি তখন পুরো ঘটনাটা খুলে বলল। শুনে পুরো দৃশ্যটা কল্পনা করে সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকে। খুবই বিচিত্র কারণে এই দুর্ধর্ষ পেপার চোরের উপর কেউ আর সে রকম রাগ হলো না!
বিকেলবেলা টুনি টুম্পাকে বলল, “এই টুম্পা যাবি আমার সাথে?”
টুম্পা চকচকে চোখে বলল, “পেপার চোরের সাথে দেখা করতে?”
“হ্যাঁ।”
“যাব।”
“চল তাহলে।”
টুনি আর টুম্পা তখন পেপার চোরের সাথে দেখা করতে ঘর থেকে বের হলো। শান্ত যেখানে রংমাখা ছেলেটাকে দেখেছে সেখানে গিয়ে তারা এদিক-সেদিক তাকাল কিন্তু রংমাখা কোনো বাচ্চাকে খুঁজে পেল না। তখন তারা রাস্তার পাশে একটা ছোট চায়ের দোকানে হাজির হলো। যে মানুষটি চা তৈরি করছে তাকে জিজ্ঞেস করল, “আঙ্কেল, আপনি কি এখানে কোনো বাচ্চাকে চিনেন যে একটা কুকুর নিয়ে ঘুরে?”
“ও। গুল্লু? তারে কে চিনে না, সবাই চিনে! আজকে কী করেছে খোদায় জানে, তার সারা শরীরে রং। একেবারে লাল বান্দর।”
টুনি আর টুম্পা একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, টুনি তখন মানুষটাকে জিজ্ঞেস করল, “গুল্লু কী করে আপনি জানেন?”
“পত্রিকা বিক্রি করে। সবার পত্রিকা আট-দশ টাকা করে, গুল্লুর পত্রিকার অর্ধেক দাম! এই পোলা যে কোত্থেকে এত সস্তায় পত্রিকা আনে খোদা মালুম!”
টুনি বলল, “গুল্লুর সাথে কি একটু কথা বলা যাবে?”
“যদি তারে খুঁজে পাও, কথা বলো।”
“কোথায় পাব গুল্লুকে?”
মানুষটা এদিক-সেদিক তাকাল, তারপর দূরে রাস্তার পাশে কয়েকটা ছেলেমেয়েকে দেখিয়ে বলল, “ঐ পোলা-মাইয়াদের জিজ্ঞেস করে দেখো। এরা মাঝে মাঝে একসাথে খেলে।”
টুনি তখন টুম্পাকে নিয়ে বাচ্চাগুলোর কাছে গেল, তারা রাস্তার পাশে ফুটপাতে আঁকিবুকি করে কিছু একটা খেলছে। টুনি আর টুম্পাকে দেখে সবাই উৎসুক চোখে তাদের দিকে তাকাল। টুনি জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কি গুল্লুকে দেখেছ?”
বাচ্চাগুলো সাথে সাথে সতর্ক হয়ে গেল। তারা পথে-ঘাটে থাকে, তাদের একে অন্যকে দেখে রাখতে হয়। ভদ্রলোকেরা যখন তাদের খোঁজ করে তখন বুঝতে হবে কিছু একটা ঝামেলা আছে। প্রায় টুনির বয়সী একটা মেয়ে চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী জন্যে?”
“এমনি। একটু কথা বলব।”
একজন ফিক করে হাসল, বলল, “আজকে আমাগো গুল্লু লাল বান্দর।”
টুনি বলল, “জানি। সেই জন্যে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।”
টুনির বয়সী মেয়েটা বলল, “হে মনে হয় কথা বলবে না।”
“না বললে নাই। কিন্তু যদি কথা বলতে চায় আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেবে প্লিজ? আমরা দুইজন ঐ যে সামনে দোকানটা দেখছ তার বাইরে যে বেঞ্চ আছে সেখানে বসে থাকব।”
“ঠিক আছে।”
টুনি আবার বলল, “ওকে বোলো কোনো ভয় নাই!”
মেয়েটা আবার মাথা নাড়ল।
তখন টুনি আর টুম্পা দুইজন দোকানটার সামনে বেঞ্চে চুপচাপ বসে অপেক্ষা করতে থাকল। টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “তোমার কী মনে হয় টুনি আপু, গুল্লু কি আসবে?”
টুনি বলল, “জানি না। দেখা যাক। এখন যেহেতু নামটা জেনে গেছি কোনো একদিন খুঁজে বের করে ফেলব। আজকে না আসলেও ক্ষতি নাই।”
মিনিট দশেক পর হঠাৎ করে টুনি আর টুম্পা দুজনেই দেখল একটা ছোট ছেলে গুটি গুটি তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ছেলেটির বয়স সাত আট বছরের বেশি হবে না, মাথার চুল এলোমেলো, একটা শার্ট, যার বোতাম খুব বেশি নেই এবং একটা কালো রঙের ঢোলা প্যান্ট। খালি পা। যেটা দর্শনীয় সেটা হচ্ছে তার সারা মুখে, বুকে এবং পেটে টকটকে লাল রং।
ছেলেটা একা আসছে না, তার পাশে পাশে হেঁটে আসছে একটা কুকুর। ভিডিওতে টুনি আর টুম্পা আগেই এই কুকুরটাকে দেখেছে। ছেলেটা একটা নিরাপদ দূরত্বে এসে দাঁড়িয়ে গেল, দেখে বোঝা যাচ্ছে বিপদ দেখলে যেকোনো সময়ে সে দৌড়ে পালাবে! টুনি মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “তুমি গুল্লু?”
গুল্লু মাথা নাড়ল। টুনি বলল, “কাছে আসো, তোমার সাথে কথা বলি।”
“কী কথা?”
“এই তো তুমি কেন পেপার চুরি করো এই সব কথা!”
টুনির কথা শেষ হবার আগেই গুল্লু এক দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল, পিছন পিছন তার কুকুর!
টুম্পা হতাশভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “আর আসবে না।”
টুনি বলল, “মনে হয় আসবে। দেখা যাক।”
টুনির ধারণা সত্যি। কিছুক্ষণ পর আবার গুল্লুকে দেখা গেল। এবারে আরো সতর্ক, কুকুরটাও তার সাথে সাথে সতর্ক। টুনি গলা উঁচু করে বলল, “কী হলো? চলে গেলে কেন?”
উত্তরটা যেহেতু অনুমান করা যায় তাই গুল্লু কোনো উত্তর দিল না। টুনি জিজ্ঞেস করল, “তোমার মুখে, কাপড়ে রং লেগেছে কেমন করে?”
গুল্লু বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল, ঠিক বোঝা গেল না। টুনি বলল, “কাছে এসে বলো।”
গুল্লু একটু কাছে এলো। টুনি আবার জিজ্ঞেস করল, “তোমার মুখে রং লেগেছে কেমন করে?”
“বোনের বিয়া ছিল। সেইখানে রং খেলছি।”
টুনি হি হি করে হাসতে শুরু করল, সাথে সাথে টুম্পাও। টুনি বলল, “মিছা কথা বলো কেন?”
গুল্লু মাথা নাড়ল, বলল, “মিছা কথা না।”
“আমি বলি কেমন করে রং লেগেছে?”
গুল্লু হা-না কিছু বলল না। টুনি বলল, “আজকে সকালে তোমার কুকুরটা দিয়ে তুমি আমাদের বাসা থেকে যে পেপারটা চুরি করেছ সেইখানে একটা শিশি ছিল। তুমি যখন শিশি খুলেছ তখন ভুস করে সব রং বের হয়ে তোমার মুখে-শরীরে লেগে গেছে!” কথা শেষ করে টুনি হি হি করে হাসতে থাকে, সাথে টুম্পাও।
গুল্লু আবার দৌড় দেবার জন্যে রেডি ছিল কিন্তু যেহেতু টুনির কথায় কোনোরকম অভিযোগ নেই এবং তার হাসিটা খুবই আন্তরিক তাই শেষ পর্যন্ত দৌড় দিল না।