কাজেই কিছুক্ষণের মাঝে শাহানার সাহায্য নিয়ে টুনি তার হাই প্রেশার শিশি তৈরি করা শিখে নিল। কাল সকালে পেপার দেবার পর এবং কুকুর এসে সেটা নিয়ে যাবার মাঝখানের কয়েক সেকেন্ড সময়ের মাঝে বাকিটা শেষ করতে হবে। সবকিছু আগে থেকে রেডি করে রাখলে সেটা অসম্ভব কিছু নয়।
টুনি তখন ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে ঘুমাতে গেল।
.
সকালবেলা এলার্ম শুনে টুনি লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠে গেল। আগে থেকে সবকিছু রেডি করে রাখা আছে, একটা ছোট শিশিতে একটু খানি খাওয়ার সোডা এবং হাজার পাওয়ারের ভয়ঙ্কর কটকটে লাল রং। এর মাঝে এক চামচ ভিনেগার দিয়ে কর্ক দিয়ে শিশিটা বন্ধ করতে হবে। সেটা সে করবে
একেবারে শেষ মুহূর্তে। টেবিলের উপর স্কচ টেপ রাখা আছে, এক টুকরা ছিঁড়ে শিশিটাকে খবরের কাগজের উপর লাগিয়ে দেবে। তাহলেই কাজ শেষ।
টুনি ঘুম ঘুম চোখে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। পেপারওয়ালার সাইকেলটা দেখলেই সে কাজ শুরু করে দেবে। জানালার কাছে বসে থেকে থেকে টুনি যখন প্রায় অধৈর্য হয়ে গেল তখন সে পেপারওয়ালার সাইকেলটা দেখতে পেল। টুনি খুবই ধৈর্য ধরে তখন ভিনেগারের শিশি থেকে এক চামচ ভিনেগার শিশিতে ঢেলে নেয়। ভেতরে বিজবিজ করে ফেনা তৈরি হতে থাকে, টুনি তখন দেরি না করে কর্কটা শক্ত করে শিশিটার মুখে লাগিয়ে নেয়। তারপর এক টুকরো স্কচ টেপ ছিঁড়ে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যায়। দরজার কাছে কান পেতে শুনল পেপারটা সিঁড়ির উপরে রেখে পেপারওয়ালা চলে যাচ্ছে।
টুনি তখন সাবধানে দরজা খুলে বের হয়, শিশিটা স্কচ টেপ দিয়ে পেপারটার উপরে লাগিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে লাফিয়ে উপরে এসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল। কয়েক সেকেন্ডের মাঝে সে কুকুরটাকে দেখতে পেল। বাসার সামনে এসে একবার ডানে-বামে তাকাল তারপর শান্ত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে পেপারটা শুকে সেটা কামড়ে ধরে হেঁটে হেঁটে চলে গেল। টুনি দেখার চেষ্টা করল আশেপাশে কোনো মানুষ আছে কি না, কিন্তু কাউকে দেখা গেল না।
ঘণ্টা খানেক পরে ঝুমু খালাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হলো। বড় খালু যে মোবাইলে এলার্ম পর্যন্ত দিতে পারে না সেটা নিয়ে সে যথেষ্ট হা-হুঁতাশ করল। এই মানুষটাকে একা একা ছেড়ে দিলে সে কী বিপদ ঘটাবে সেটা নিয়েও সে নানা রকম আশঙ্কা প্রকাশ করল।
সকালবেলা যখন এই বাসার সব বাচ্চাকাচ্চা স্কুলে যাবার জন্যে রেডি হয়েছে তখন টুনি সবাইকে উদ্দেশ করে বলল, “সবাই আজকে স্কুলে যাবার সময় চোখ-কান খোলা রাখবে।”
শান্ত বলল, “তোর কি ধারণা আমরা চোখ-কান বন্ধ রেখে হাতড়াতে হাতড়াতে এখানে-সেখানে বাড়ি খেতে খেতে স্কুলে যাই?”
টুনি শান্তর কথা না শোনার ভান করে বলল, “যদি দেখো কোনো মানুষের মুখ, হাত, শরীর লাল রঙে মাখামাখি তাহলে আমাকে জানাবে।”
“কেন?”
“সেটা আমি এখন বলব না। যদি দেখো তাহলে বলব।” শান্ত গরম হয়ে বলল, “এখন কেন বলবি না?”
“তোমার জন্যে। তুমি যদি জানো তাহলে তুমি মারপিট শুরু করে দিতে পারো সে জন্যে এখন বলব না। তোমার মেজাজ খুব গরম, আমি চাই না তুমি রাস্তা-ঘাটে মারামারি করো।”
শান্ত খুবই বিরক্ত হয়ে বলল, “তুই কী বললি? কী বললি? আমার মেজাজ গরম? আমি মারামারি করি?”
টুনি খুবই শান্তভাবে বলল, “আমি এখন কিছুই বলব না। কিন্তু আজকে স্কুলে যাবার সময় কিংবা ফিরে আসার সময় যদি দেখো কোনো মানুষ লাল রঙে মাখামাখি হয়ে আছে তাহলে এসে আমাকে জানাবে।”
শান্ত বলল, “জানাব না কচু! আমার আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই তোর জন্যে রাস্তাঘাটে রঙিন মানুষ খুঁজে বেড়াব। হাহ!”
বিকেলবেলা স্কুল থেকে ফিরে এসে শান্ত ছুটতে ছুটতে টুনির কাছে গেল, বলল, “টুনি টুনি, শুনে যা কী হয়েছে।”
“কী হয়েছে?”
“এই রাস্তার মোড় দিয়ে হেঁটে আসছি, দেখি একটা পিচ্চি-এই এতটুকু সাইজ! (শান্ত সাইজটা দেখাল, যেটা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য না) মুখ, পেট, বুক টকটকে লাল রং। আমি ডাকলাম আর সাথে সাথে দিল দৌড়। পিছনে পিছনে একটা কুত্তা। সেটাও দৌড়! এখন বল ব্যাপারটা কী হয়েছে?”
টুনি চোখ ছোট ছোট করে বলল, “মানুষটা পিচ্চি?”
“হ্যাঁ, মনে হয় দুই বছর বয়স হবে।”
“দুই বছর বেশি ছোট, দুই বছরের বাচ্চা হাঁটতেই পারে না।”
শান্ত অধৈর্য হয়ে বলল, “আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। না-হয় আরো বড় হবে, পাঁচ-ছয় বছর, কিংবা সাত-আট বছর–”
“কিন্তু ছোট বাচ্চা? বড় মানুষ না?”
“হ্যাঁ ছোট বাচ্চা।”
শান্ত আরো অধৈর্য হয়ে বলল, “বল ব্যাপারটা কী?”
টুনি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “না, বলা যাবে না।”
শান্ত চিৎকার করে বলল, “বলা যাবে না মানে?”
“বলা যাবে না মানে বলা যাবে না। মানুষটা যদি একটা বড় মানুষ হতো তাহলে বলতাম। কিন্তু মানুষটা যেহেতু ছোট বাচ্চা এখন আর বলা যাবে না।”
“কেন ছোট বাচ্চা হলে বলা যাবে না?”
“তাহলে তুমি বাচ্চাটাকে ধরে আছাড় দিবে। বাচ্চাটার ঠ্যাঙ ভেঙে দিবে।”
শান্ত চোখ কপালে তুলে বলল, “কেন আমি একটা ছোট বাচ্চার ঠ্যাং ভেঙে দিব?”
“তুমি যদি কথা দাও বাচ্চাটাকে কিছু বলবে না তাহলে বলতে পারি।”
শান্ত বলল, “কথা দিলাম।”
“ভালো করে বলো, কসম খেয়ে বললো।”
ব্যাপারটা কী হয়েছে জানার জন্যে শান্তর এত বেশি কৌতূহল হচ্ছিল যে শেষ পর্যন্ত কসম খেল।