বাচ্চারা সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠল, শান্তর গলা শোনা গেল সবচেয়ে উপরে, বলল, “ইয়া মাবুদ! এইটা তো দেখি একটা কুত্তা!”
কুকুরটা যতক্ষণ পর্যন্ত দেখা গেল সবাই সেটার দিকে তাকিয়ে রইল, কুকুরটা হেলে-দুলে যেতে যেতে একসময় টেলিভিশনের স্ক্রিন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল!
ছোটাচ্চু ভিডিওটা বন্ধ করে কেমন যেন বোকার মতো সবার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “একটা কুকুর!”
দাদি খুশি খুশি গলায় বললেন, “এই জন্যেই তো চিঠি পড়তে পারে নাই।”
বড় চাচা বললেন, “একটা কুকুর এতদিন থেকে আমার পেপার নিয়ে যাচ্ছে?”
বাচ্চাদের একজন বলল, “নিয়ে কী করে? পড়ে?”
আরেকজন তার মাথায় চাটি দিলে বলল, “ধুর গাধা! কুকুর পেপার পড়বে কেমন করে?”
“তাহলে কেন নিয়ে যায়?”
ঝুমু খালা তখন তার ব্যাখ্যা দিল, বলল, “একেক কুত্তার একেক রকম খেয়াল। খোঁজ নিয়া দেখো এই কুত্তার নিজের জায়গা আছে, সেইখানে সব পত্রিকা জমা করে রাখে।”
শান্ত জানতে চাইল, “কেন জমা করে?”
“মনে হয় বিছানার মতো করে তার উপরে ঘুমায়। মনে হয় কুত্তাটা জলা জায়গায় থাকে। সেইখানে পেপার দিয়ে জায়গাটা শুকনা রাখে।”
ঝুমু খালা অবশ্যি এখানে থেমে গেল না, কুকুরের সাইকোলজি নিয়ে আরো অনেকক্ষণ অনেক রকম কথা বলল।
টুনি ছোটাচ্চুকে বলল, “ছোটাচ্চু, ভিডিওটা আরেকবার দেখতে পারি?”
ছোটাচ্চু তখন ভিডিওটা আরো একবার চালু করল, সবাই মিলে তখন আরো একবার ভিডিওটা দেখল, প্রথমবারে যেটা দেখেছিল তার থেকে ভিন্ন কিছু কারো চোখে পড়ল না, শুধু টুনি সোজা হয়ে বসে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল। দেখা শেষ হবার পর টুনি আবার ভিডিওটা দেখল, তারপর আবার, তারপর আবার! অন্যেরা বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিল, শান্ত বলল, “তুই বন্ধ করবি? এই কুত্তাটাকে দেখতে দেখতে মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে।”
টুনি তখন ভিডিওটা দেখা বন্ধ করল।
বড় চাচা বললেন, “তাহলে আমার পেপার দেখার কোনো উপায় নাই? একটা নেড়ি কুকুর আমার পেপার পড়া বন্ধ করে দেবে?”
ছোটাচ্চু বলল, “যদি ক্রিমিনালটা মানুষ হতো আমি তোমার প্রবলেম সল্ভ করে দিতাম। ক্রিমিনাল যখন কুকুর তখন কীভাবে সেটাকে সল্ভ
করব আমি জানি না! এই দেশে কুকুরের বিরুদ্ধে কোনো আইন নাই।”
বড় চাচা একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
ছোটাচ্চু বলল, “একটা বড় এলসেশিয়ান কুকুর নিয়ে আসতে পারি। বাড়ি পাহারা দেবে, ঐ নেড়ি কুকুর তখন ধারে-কাছে আসবে না।”
ছোট একজন বলল, “না, না, না, কুকুর আমার অনেক ভয় করে।”
শান্ত বলল, “কুকুরকে ভয় করার কী আছে? কাছে আসলে কষে একটা লাথি দিবি।”
ঝুমু খালা বলল, “কুকুর বান্ধা তাবিজ আছে। বাম হাতে কালা সুতা দিয়ে বাঁধতে হয়। কুকুর-বিড়াল কাছে আসবে না।”
বড় চাচা বলল, “তোমার তাবিজ বাসার দরজায় ঝুলিয়ে রাখা যায় না? তাহলেই তো কুকুর আসত না।”
ঝুমু খালা বলল, “খালুজান, আপনি চিন্তা কইরেন না। আমি সকালবেলা ঝাড় নিয়া বাসার দরজার কাছে বসে থাকমু। কুত্তার কাছ থেকে আমি যদি আপনার পত্রিকা উদ্ধার না করি তাহলে আমার নাম ঝুমু না।”
টুনি হেসে বলল, “তুমি সকালে ঘুম থেকে উঠতেই পারো না ঝুমু খালা! আমরা সবাই মিলে ডেকেও তোমার ঘুম ভাঙাতে পারি না।”
ঝুমু খালা মাথা চুলকে বলল, “সেইটা অবশ্যি সত্যি কথা। কেউ যদি ঘুম থেকে তুলে দেয়–খালুজান আমাকে ডেকে তুলে দিতে পারবেন না?”
বড় চাচা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “তোমাকে যদি সকালে ঘুম থেকে তুলতেই হয় তাহলে আমি নিজে গিয়ে কেন খবরের কাগজটা নিয়ে আসব না?”
ঝুমু খালা বলল, “কিন্তু খালুজান আপনি তো আমার মতোন কুত্তাটারে ঝাড় দিয়ে পিটাতে পারবেন না, পারবেন?”
বড় চাচা উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে আবার থেমে গেলেন।
রাত্রিবেলা ঘুমানোর আগে টুনি টুম্পাকে বলল, “টুম্পা তোকে একটা কথা বলি, কাউকে বলবি না তো?”
টুম্পা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ল, বলল, “বল। কাউকে বলব না।”
“কুকুরটা কিন্তু নিজে নিজে বড় চাচার পেপার নিচ্ছে না। কেউ একজন কুকুরটাকে দিয়ে পেপার নেওয়াচ্ছে।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ সত্যি।”
“তুমি কেমন করে বুঝলে?”
“দেখলি না কুকুরটা কত যত্ন করে পত্রিকাটা নিল। প্রথমে নাক দিয়ে ঠেলে সিঁড়ির কাছে নিয়ে তারপর এক কোনায় কামড় দিল, যেন পত্রিকাটা নষ্ট না হয়।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ সত্যি।” টুনি গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল, “আমার মনে হয় একজন মানুষ সকালবেলা একটা কুকুরকে দিয়ে সবার বাসা থেকে পত্রিকাগুলো জড়ো করে, তারপর বিক্রি করে।”
টুম্পা মাথা নাড়ল, সে টুনির সব কথা সব সময় বিশ্বাস করে।
টুনি বলল, “তা ছাড়া কুকুর কেন খামোখা পেপার নিয়ে যাবে? সে পেপার খেতেও পারে না, পড়তেও পারে না, গায়েও দিতে পারে না। কেউ একজন কুকুরকে ট্রেনিং দিয়েছে।”
টুম্পা আবার মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক বলেছ।”
টুনি বলল, “পেপার চোরটাকে ধরতে হবে, কুকুরকে ধরে লাভ নাই।”
“কেমন করে ধরবে?”
টুনি বলল, “চিন্তা করছি।”
তারপর গালে হাত দিয়ে চিন্তা করতে শুরু করল। টুনি যখন চিন্তা করে তখন তাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না বলে টুম্পাও চুপচাপ পাশে গালে হাত দিয়ে বসে রইল।
এ রকম সময় ঝুমু খালাকে দেখা গেল একটা শলার ঝাটা নিয়ে যাচ্ছে। টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “এত রাতে ঝাড় নিয়ে কই যাও ঝুমু খালা?”