টুনি ঠান্ডা গলায় বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি শুনেছ আমি কী বলেছি?”
ছোটাচ্চু বলল, “শুনেছি। বাসা থেকে পেপার চুরি হয়ে যাচ্ছে।”
“তাহলে?”
“তাহলে কী?”
টুনি বলল, “তাহলে সেটা নিয়ে তোমার কোনো চিন্তা হচ্ছে না?”
ছোটাচ্চু হা হা করে হাসল, বলল, “গত মাসে আমি হীরার নেকলেস চুরির একটা কেস ভ করেছিলাম মনে আছে?”
টুনি মাথা নাড়ল, মনে না রেখে উপায় নাই, ছোটাচ্চু সেটাতে হাজার রকম রং-চং লাগিয়ে গল্প করেছে। ছোটাচ্চু বলল, “আমি হীরার নেকলেস চুরির কেস সল্ভ করি, পেপার চুরি শুনে লাফানো কি আমাকে মানাবে বল?”
টুনি কোনো কথা বলল না। ছোট একজন বলল, “আসলে ছোটাচ্চু পেপার চোর ধরতে পারবে না। তাই না?”
“কী বললি?”
“দাদি ভেবেছিল চোরের কাছে চিঠি লিখলে চোর আর চুরি করবে না। তাই না দাদি?”
ছোটাচ্চু প্রথমে চোখ কপালে তুলল তারপর পেটে হাত দিয়ে হা হা করে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে দাদির দিকে তাকিয়ে বলল, “মা, তুমি তাই ভেবেছ? চোরকে চিঠি লিখলে চোর সেই চিঠি পড়ে ভালো হয়ে যাবে!” তারপর আবার হা হা করে হাসতে লাগল।
দাদি বললেন, “আমার মনে হয় চিঠির ভাষাটা একটু কঠিন হয়ে গেছে, আরেকটু সহজ ভাষায় লেখা উচিত ছিল।”
শান্ত যে চিঠির শেষে খুব সহজ ভাষায় আরেকটা লাইন লিখে দিয়েছিল, তারপরও যে কোনো কাজ হয় নাই সেটা সে আর কাউকে বলল না।
হাসতে হাসতে ছোটাচ্চুর চোখে পানি এসে গেল, তখন টুনি বলল, “তুমি এ রকম বোকার মতো হাসছ কেন ছোটাচ্চু? দাদি তো তবু চুরি থামানোর চেষ্টা করেছে। তুমি তো কিছুই করছ না!”
ছোট একজন বলল, “আসলে ছোটাচ্চু পেপার চোর ধরতে পারবে না। তাই না ছোটাচ্চু?”
ছোটাচ্চু মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমি আল্টিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির সি.ই.ও. দেশের প্রথম রেজিস্টার্ড প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি, আমি ন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনালদের ধরি, আর তুই ভাবছিস আমি একটা ছিচকে পেপার চোরকে ধরতে পারব না?”
“তাহলে ধরো।”
“ঠিক আছে। আগামীকাল এই সময়ে এই জায়গায় পেপার চোরকে হাজির করা হবে।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “চোরকে কীভাবে ধরবে ছোটাচ্চু?”
“খুবই সোজা। বাসার দরজায় সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে দেব। সবকিছু রেকর্ড হয়ে যাবে। ইনফ্রারেড ক্যামেরা, রাতের অন্ধকারেও কেউ যদি কিছু করে তারও ভিডিও উঠে যাবে। দেখি তোর পেপার চোর কেমন করে পেপার চুরি করে।”
ছোটাচ্চু তখন খুবই গম্ভীরভাবে পকেট থেকে তার দামি ফোনটা বের করে কোথায় জানি ফোন করে দিল, কাকে জানি বলল আজ রাতের মাঝে বাসার সামনে একটা ক্যামেরা লাগিয়ে দিতে। ছোটাচ্চু এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, টেলিফোন করে এ রকম কাজ করে ফেলতে পারে।
.
সত্যি সত্যি রাতের বেলা একজন এসে কী যেন একটা লাগিয়ে দিয়ে চলে গেল। টুনি ছোটাচ্চুকে জিজ্ঞেস করল, “আমরা এখন বাসার ভিতরে বসে ক্যামেরায় কী হচ্ছে দেখতে পারব?”
ছোটাচ্চু মাথা নেড়ে বলল, “নাহ। এটা আসল সি.সি. ক্যামেরা না। একটা সাধারণ ভিডিও ক্যামেরা, ক্যামেরাটা খুলে টেলিভিশন না-হলে ল্যাপটপে দেখতে হবে। এখন সবাই দোয়া কর যেন কালকে পেপার চোর পেপার চুরি করে নিয়ে যায়। আমরা চোরের চেহারাটা দেখতে চাই!”
কাউকে আলাদা করে দোয়া করতে হলো না। সকালবেলা পেপারওয়ালা পেপার দিয়ে গেল, কিছুক্ষণের মাঝে পেপার উধাও হয়ে গেল। ক্যামেরাটা দরজার উপরে লাগানো আছে, সেখানে চোরের পুরো ভিডিও রেকর্ড করা আছে এখন শুধু দেখতে হবে কে সেই চোর!
বাসায় সবার মাঝে উত্তেজনা, কখন ছোটাচ্চু আসবে এবং কখন ভিডিওটা দেখা হবে। দিন আর কাটতে চায় না, শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যা হলো, সন্ধ্যা পার হয়ে রাত হলো। হোমওয়ার্ক শেষ হলো (কিংবা শেষ হলো না, কারণ শেষ করার চেষ্টাই করা হলো না)। রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ হলো, তারপর বসার ঘরে দাদিকে ঘিরে সবাই বসে ঘড়ি দেখতে লাগল। কয়েক মিনিট পর পর ছোটাচ্চুকে ফোন করা হতে থাকল এবং শেষ পর্যন্ত ছোটাচ্চু এসে হাজির হলো। ছোটাচ্চু বাসায় ঢোকার সময় দরজার ওপর থেকে ভিডিও ক্যামেরাটা খুলে এনেছে; এখন শুধু টেলিভিশন কিংবা ল্যাপটপে পুরো ভিডিওটা দেখা।
ছোটাচ্চু একটা তার বের করে টেলিভিশনের পিছনে লাগিয়ে সেটা তার ভিডিও ক্যামেরার সাথে লাগিয়ে নিল, তারপর কোথায় কী সুইচ টিপে দিতেই টেলিভিশনে ভিডিওটা দেখা যেতে শুরু হলো।
দরজার সামনে সিঁড়ি, সিঁড়ির সামনে হাঁটার পথ, তার সামনে রাস্তা। সকালবেলার দৃশ্য, রাস্তায় খুব বেশি মানুষ নেই, মাঝে মাঝে একজন-দুইজন হেঁটে যাচ্ছে, হঠাৎ করে একটা রিকশা না-হয় সি.এন.জি.। সবাই ধৈর্য ধরে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে আছে এবং তখন শেষ পর্যন্ত পেপারওয়ালাকে দেখা গেল। সে বাসার সামনে তার সাইকেলটা থামাল, স্ট্যান্ডটা বের করে সাইকেলটা দাঁড় করাল তারপর পিছন থেকে একটা পত্রিকা বের করে বাসার সামনে সিঁড়িতে রাখল। তারপর সাইকেলের কাছে গিয়ে সেটা ঠেলে একটু সামনে নিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল।
সবাই রুদ্ধ নিশ্বাসে পেপারটার দিকে তাকিয়ে থাকে, এক্ষুনি পেপার চোর আসবে, ঝট করে পেপারটা তুলে বের হয়ে যাবে। বসার ঘরে কোনো শব্দ নেই। সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে।
ঠিক তখন বাসার সামনে একটা কুকুর এসে দাঁড়াল। কুকুরটা ডানে বামে তাকাল, তারপর সিঁড়ি দিয়ে উঠে খবরের কাগজটা মুখে কামড়ে ধরে খুবই শান্তভাবে হেঁটে নেমে গেল। কুকুরটার মাঝে কোনো তাড়াহুড়া নেই, কোনো উত্তেজনা নেই, দেখে মনে হতে থাকে বিষয়টা খুবই স্বাভাবিক।