নিয়ম অনুযায়ী পরপর দুইবার খেলায় জিততে হবে। কিন্তু প্রথমবার হারার পরই মিশু পরাজয় স্বীকার করে নিল। সে আর খেলতে চাইল না।
.
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আবার দাদিকে প্রধান অতিথি হিসেবে ধরে আনা হলো। দাদির সাথে ঝুমু খালাও চলে এসেছে। দুইটা চেয়ারে দুইজনকে বসানো হয়েছে। ঝুমু খালা দাদির পাশে চেয়ারে বসতে রাজি হচ্ছিল না তখন দাদি তাকে একটা ধমক দিলেন, বললেন, “দেখছ না বাচ্চারা একটা অনুষ্ঠান করছে তুমি তার মাঝে ঝামেলা করছ। যা বলছে শুনো।”
ঝুমুখালা তখন কাঁচুমাচু হয়ে দাদির পাশে বসল। সবাই তখন বক্তৃতা দিল, দাদি বক্তৃতা দেয়ার সময় বললেন, “দিন-রাত খালি খেললে হবে না, লেখাপড়াও করতে হবে। এই দেখিস না মিশু লেখাপড়া করে কত বড় হয়েছে–”
টুনি তখন হাত তুলে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা দাদি একজন যদি লেখাপড়া করে চোর হয় সেইটা ঠিক আছে?”
দাদি বললেন, “ধুর! সেইটা ঠিক হবে কেন? লেখাপড়া করে চোর হবে কেন?
“যদি হয়?”
“না, না। ছিঃ।” দাদি জোরে জোরে মাথা নাড়ল। বলল, “লেখাপড়া করে কেউ যেন চোর না হয়।”
বক্তৃতা পর্ব শেষ হবার পর প্রথমে মিশুকে রানার্সআপের পুরস্কার হিসেবে একটা সার্টিফিকেট দেয়া হলো। সার্টিফিকেটের এক কোনায় লাল কলম দিয়ে কে যেন লুডো খেলার মন্ত্রটা লিখে রেখেছে। সেটা দেখে মিশুর কান পর্যন্ত লাল হয়ে উঠল।
মিশুর পর মুনিয়াকে তার পুরস্কারের একশ টাকা তুলে দেয়া হলো। দর্শকদের চিৎকারে ঘর ফেটে যাবার অবস্থা।
শান্ত জিজ্ঞেস করল, “মুনিয়া তুই এত টাকা দিয়ে কী করবি? আমাকে অর্ধেক দিয়ে দে।”
“না দিব না।” মুনিয়া মাথা নেড়ে বলল, “আমার লাগবে।”
“কেন লাগবে?”
“বলব না।”
শান্ত বলল, “বল। শুনি।”
“উঁহু বলব না।”
টুম্পা বলল, “আমি জানি। বলব?”
মুনিয়া গলা উঁচিয়ে বলল, “না। তুমি বলতে পারবে না আপু। ভালো হবে না কিন্তু।”
কাজেই টুম্পা সেটা বলতে পারল না। বলতে না পারলেও কোনো ক্ষতি হয়নি। কারণ কারণটা কীভাবে কীভাবে জানি সবাই জেনে গেছে। তাদের বাসার সামনের রাস্তাটি প্রতিদিন ভোরে একজন মহিলা ঝট দেয়। তার ছোট একটা বাচ্চা আছে, বাচ্চাটাকে পথের ধারে বসিয়ে রাখে। ধুলাবালির মাঝে নোংরা একটা শার্ট পরে সে বসে বসে চারিদিকে তাকায়, হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটে। পথ থেকে নোংরা, ময়লা, সিগারেটের বাঁট তুলে মুখে দিয়ে দেয়। বাচ্চাটার জন্য মুনিয়ার খুব মায়া হচ্ছে। স্কুলে যাবার সময় তাকে পেলে মুনিয়া তার সাথে কথাবার্তা বলে। বাচ্চাটা ঢুলুঢুলু চোখে তার দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে ফিক করে হেসে দেয়। মুনিয়া এই বাচ্চার জন্য একটা সুন্দর জামা কিনতে চায়-খোঁজ নিয়ে জেনেছে সে জন্যে একশ টাকার মতো লাগবে। সেই জন্যেই তার টাকাটা দরকার!
মিশুর আরো কয়েক দিন থাকার কথা ছিল কিন্তু সেই দিন বিকালেই সে চলে গেল। শান্ত তাকে রাস্তার মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। লুডো খেলার সময় আসলে কী কী ঘটেছে সেটা এতক্ষণে সবার কাছে জানাজানি হয়ে গেছে।
মিশুকে বিদায় দেবার আগে শান্ত বলল, “বুঝলে মিশু ভাইয়া, তুমি বলেছিলে না বেশি ভালো মানুষ হয়ে লাভ নাই? মাঝে মাঝে দুই নম্বরি হতে হয়। বলেছিলে না?”
মিশু কথা না বলে চুপ করে রইল। শান্ত বলল, “কথাটা ঠিক না। দুই নম্বরি হওয়া খুবই ডেঞ্জারাস।”
মিশু এবারেও কথা বলল না, মুখটা শুধু আরেকটু শক্ত হয়ে গেল। শান্ত বলল, “তোমার মাথায় যে রকম বুদ্ধি, আমাদের টুনির মাথাতেও সে রকম অনেক বুদ্ধি! একেবারে চিকন বুদ্ধি। তোমার থেকে বেশি। তুমি দুই নম্বরি কাজ করেছ দেখে তোমাকে টাইট করে ছেড়ে দিয়েছে। দিয়েছে কি না?”
মিশু হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বলল না। শান্ত দার্শনিকের মতো বলল, “বুঝলে মিশু ভাইয়া। দুই নম্বরি মানুষ হওয়া ঠিক না! ধরা পড়লে মাইর খাওয়ার চান্স থাকে। মাইর মানে মাইর–উথাল-পাতাল মাইর। অস্থির মাইর! বেইজ্জতির চূড়ান্ত। বেইজ্জতি বলে বেইজ্জতি…।”
শান্তর কথা শেষ হওয়ার আগেই মিশু প্রায় লাফ দিয়ে একটা চলন্ত বাসে উঠে গেল!
হ্যাকার
বসার ঘরে দাদি বসে টেলিভিশন দেখছেন, কী কারণে তার পায়ের গোড়ালিতে ব্যথা এবং সেটা নিয়ে ঝুমু খালার উৎসাহের সীমা নেই। কী একটা গাছের পাতা হেঁচে ঝুমু খালা দাদির পায়ে মাখিয়ে দিয়েছে সে কারণে দাদির শরীর থেকে ঝাঁঝালো একধরনের গন্ধ বের হচ্ছে। বসার ঘরে যে-ই ঢুকছে ঝুমু খালা তাকেই তার এই টোটকা ওষুধের গুণগান শুনিয়ে যাচ্ছে। বলছে, “এই যে খালার পায়ে ধানকুচি গাছের পাতা ঘেঁচে দিছি, এই ওষুধ হচ্ছে ধন্বন্তরী।”
টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “ধন্বন্তরী মানে কী?”
ঝুমু খালা মাথা চুলকে বলল, “ধন্বন্তরী মানে হচ্ছে ওষুধের বাবা ওষুধ।”
দাদি তখন একটু শুধরে দিলেন, বললেন, “ভালো ডাক্তার হচ্ছে। ধন্বন্তরী।”
ঝুমু খালা মাথা নেড়ে বলল, “একশবার। ওষুধের বাবা ওষুধ হচ্ছে। ডাক্তার। ধন্বন্তরী ডাক্তার।”
মুনিয়া বলল, “কিন্তু দাদির শরীর থেকে কেমন যেন শুঁটকি মাছের মতো গন্ধ বের হচ্ছে।”
ঝুমু খালা বলল, “এই গন্ধ হচ্ছে চিকিৎসা। যত ভালো চিকিৎসা তত বেশি গন্ধ। খালারে জিজ্ঞেস করে দেখ তার পায়ের ব্যথা কমেছে কি না। জিজ্ঞেস করো।”
টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “দাদি, তোমার পায়ের ব্যথা কমেছে?”