টুনি ছক্কাটা বোর্ডের উপর রেখে বলল, “নে মুনিয়া খেল।”
মুনিয়া খেলার আগে মিশু ছক্কাটা হাতে নেয় এবং ঘুরিয়ে দেখে হঠাৎ করে তার মুখটা জানি কেমন হয়ে যায়। এই ছক্কাটা আগের ছক্কা থেকে একটু বড়, দেখতেও ভিন্ন। কাজেই সে আর হাতসাফাই করে নিজের দুই নম্বরী ছক্কা দিয়ে বদলে দিতে পারবে না! বদলে দিলেই সবাই ধরে ফেলবে। মিশু ছক্কাটা নিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল।
টুনি জিজ্ঞেস করল, “কিছু বলবে মিশু ভাইয়া?”
মিশু বলল, “না, মানে ইয়ে-না–মানে কিছু বলব না।”
টুনি মুনিয়াকে বলল, “মুনিয়া খেল।”
মুনিয়া ছক্কাটা ফেলার আগে টুনি তাকে থামাল, বলল, “মুনিয়া এক সেকেন্ড দাঁড়া। তোকে একটা মন্ত্র শিখিয়ে দেই।”
“মন্ত্র?”
“হ্যাঁ। লুডো খেলার মন্ত্র। এই মন্ত্র পড়লে ছয় ওঠে।”
“যাহ্!” মুনিয়া অবিশ্বাসের শব্দ করল, বলল, “ছয় ফেলার মন্ত্র আবার আছে নাকি?”
“আছে। তুই চেষ্টা করে দেখ। আসল সোলেমানী জাদু বই থেকে শিখেছি।”
মুনিয়া এবারে মনে হয় একটু বিশ্বাস করল। জিজ্ঞেস করল, “কী মন্ত্র?”
টুনি বলল, “ছক্কাটা ফেলার আগে বলবি–
পাঁচ ঘষে ছয়, দুই নম্বরী ছক্কা
তুমি ভাব বুদ্ধি বেশি
আসলে তো ফক্কা!”
মুনিয়া একটু অবাক হয়ে টুনির দিকে তাকাল, বলল, “এইটা মন্ত্র?”
“হ্যাঁ। এইটা মন্ত্র আমার সাথে বল–”
মুনিয়া টুনির সাথে মন্ত্রটা বলল এবং ছক্কাটা ফেলল, সবাই দেখল ছক্কাটা বোর্ডের উপরে গড়িয়ে যেতে যেতে হঠাৎ করে থেমে গিয়ে একটা ডিগবাজি দিয়ে ছয় হয়ে গেল। দর্শকদের ভেতর থেকে বিশাল একটা আনন্দধ্বনি শোনা গেল।
টুনি আড়চোখে মিশুর দিকে তাকাল, দেখল মিশুর চেহারাটা হঠাৎ কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সে একবারও সন্দেহ করেনি এই ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো তার চালাকিটা ধরতে পারবে। শুধু যে ধরে ফেলেছে। তা নয়, সেটা নিয়ে কবিতা বানিয়ে তাকে টিটকারি করছে। কী সর্বনাশ!
মুনিয়া আবার ছক্কা ফেলার জন্যে প্রস্তুত হয়েছে; টুনিকে আবার মন্ত্রটা উচ্চারণ করতে হলো, মুনিয়া আবার টুনির সাথে সাথে মন্ত্রটা উচ্চারণ করল এবং ছক্কা ফেলল। ছক্কাটা আবার গড়িয়ে যেতে যেতে হঠাৎ করে কেমন জানি ব্রেক করে একটা লাফ দিয়ে ছয় হয়ে গেল। আবার বিশাল আনন্দধ্বনি, শুধু মিশু ছক্কার এই বিচিত্র আবরণ দেখে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল।
তৃতীয়বার ছক্কা খেলার সময় টুনি তার চুম্বকটা সরিয়ে রাখল, এবারে একটা চার উঠল। মুনিয়া তার দুটো খুঁটি তুলে একটা চার চেলে ছক্কাটা মিশুর দিকে এগিয়ে দিল।
মিশু আড়চোখে সবার দিকে একবার তাকিয়ে ছক্কাটা ফেলল, ছক্কাটা গড়িয়ে যায় এবং সত্যি সত্যি একটা ছয় উঠে গেল। দর্শক এবারে একটু থিতিয়ে যায়। টুনি মুনিয়াকে বলল, “তুই আবার মিশু ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে মন্ত্রটা বল, দেখি কাজ করে কি না।”
মুনিয়া মিশুর দিকে আঙুল নেড়ে নেড়ে বলল—
“পাঁচ ঘষে ছয়, দুই নম্বরি ছক্কা
তুমি ভাবো বুদ্ধি বেশি
আসলে তো ফক্কা!”
মুনিয়ার মন্ত্রে কাজ হলো। দেখা গেল পরপর আরো দুটি ছয় উঠে তিন ছক্কার কারণে সব বাতিল হয়ে গেল। চতুর্থবার যখন খেলেছে তখন ছক্কাটা শুধু যে বিচিত্রভাবে লাফ দিয়ে ডিগবাজি খেয়ে যে এক হয়ে গেল তা নয়, সেই অবস্থায় একটু ঘুরপাকও খেল। কাজেই মিশুর কপালে জুটেছে মাত্র এক।
সবাই আনন্দধ্বনি করল এবং আনন্দধ্বনি থামার পর মিশু শুকনো গলায় বলল, “কিছু একটা গোলমাল আছে।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী গোলমাল মিশু ভাইয়া?”
“ছক্কাটা ঠিকভাবে পড়ছে না। কেমন যেন—”
“কেমন যেন কী?”
মিশু বাক্যটা শেষ না করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বলল, “না, কিছু।”
এতক্ষণে মন্ত্রটা অন্য সবাই শিখে গেছে কাজেই প্রতিবার দান চালার সময় সবাই সমস্বরে চিৎকার করে মন্ত্র পড়তে লাগল এবং প্রতিবার মুনিয়ার কমপক্ষে একটা করে ছয় উঠতে লাগল। শুধু তা-ই না, মন্ত্রটা মিশুর বিরুদ্ধে কাজ করছে তাই প্রত্যেকবার তার এক উঠতে লাগল।
মিশুকে প্রথমে একটু হতবাক, তারপরে বিষণ্ণ, শেষে রীতিমতো অসুস্থ দেখাতে লাগল। সে যেহেতু বুদ্ধিমান তাই কিছুক্ষণের মাঝেই কী হচ্ছে বুঝে গেল। কিন্তু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল না। একবার খুবই দুর্বলভাবে বলল, “ইয়ে-মানে-একটা জিনিস লক্ষ করেছ! আমার উঠছে শুধু এক আর মু-ি নয়ার উঠছে শুধু ছয়। এটা খুবই বিচিত্র। প্রোবাবিলিটির নিয়ম অনুযায়ী এটা সম্ভব না।”
টুনি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “তুমি ঠিকই বলেছ মিশু ভাইয়া। এইবারের টুর্নামেন্টে সবই আজব। আমি লক্ষ করছিলাম তুমি যখন খেলছিলে একবারও পাঁচ ওঠে নাই। এইটা কি সম্ভব?”
মিশু আমতা আমতা করে বলল, “পাঁচ? মানে পাঁ পা পাঁচ?”
“হ্যাঁ। প্রোবাবিলিটির নিয়ম কি বলে মিশু ভাইয়া? পাঁচ না উঠে তার বদলে ছয় ওঠার প্রোবাবিলিটি কি সমান নাকি বেশি?”
উপস্থিত দর্শকেরা অবশ্যি টুনি এবং মিশুর এই আলাপে কোনো কৌতূহল দেখাল না। তারা মন্ত্র এবং মন্ত্রের ফলাফল দেখেই খুশি, এ রকম আসলেই হওয়া সম্ভব কি না সেটা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই।
কিছুক্ষণের মাঝেই মিশু খেলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলল এবং দেখা গেল মুনিয়া যখন তার সবগুলো খুঁটি পাকিয়ে ফেলল তখনো তার সবগুলো খুঁটি ঘরের মাঝে আটকা পড়ে আছে, লুডো খেলার ইতিহাসে এ রকম হৃদয়বিদারক ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেছে বলে মনে হয় না!