শান্ত চিন্তিত মুখে বলল, “তাহলে লুডো খেলবে কেমন করে? টুর্নামেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে না?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “না, না টুর্নামেন্ট বন্ধ হবে না। আমার কাছে অন্য ছক্কা আছে।”
“তার মানে তুই ছক্কাটা বদলে দিতে চাস?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“এখন জানতে চেয়ো না, পরে বলব।”
“শান্ত মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে। দশ টাকা।”
“আগে কাজ শেষ করে তারপর টাকা।”
“দিবি তো?”
“দিব। তুমি আর একটা কাজ করে দেবে?”
“কত টাকা?”
টুনি মাথা নাড়ল, “উঁহু, এটার জন্যে কোনো টাকা নাই। আমাদের টুর্নামেন্টের ছবি তুলে দাও। ছবি আর ভিডিও। মিশু ভাইয়া যখন খেলে তখন লুডো বোর্ডের ভিডিও!”
“লুডো বোর্ডের ভিডিও?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“পরে বলব।”
“ঠিক আছে।”
.
শাহানা বলেছিল তাকে ঘণ্টা খানেক সময় দিতে। কিন্তু সে আধা ঘণ্টার মাঝে ম্যাজিক ছক্কাটা তৈরি করে দিল। দেখে বোঝার উপায় নেই এই ছক্কার মাঝে এত ইঞ্জিনিয়ারিং করা হয়েছে। চোখের কাছে নিয়ে খুব ভালো করে পরীক্ষা করলে বোঝা যায় এটা মাঝখানে কেটে আবার জোড়া দেয়া হয়েছে।
শাহানা টুনির হাতে ছক্কা আর একটা চুম্বক দিল। টুনির ধারণা ছিল চুম্বক মানেই একটা লোহার বার, এক পাশে লাল অন্য পাশে কালো রং করা। কিন্তু শাহানা দিল চ্যাপটামতো একটা ধাতব টুকরো, এইটা নাকি চুম্বক। তারপর সেটা শাহানার টেবিলের উপর পরীক্ষা করল, টেবিলের উপর ছক্কাটা ছেড়ে দিয়ে টুনি নিচে চুম্বকটা ধরতেই ছক্কাটা কেমন জানি লাফ দিয়ে ছয় উঠে গেল! যতবার পরীক্ষা করল ততবার ছয়! আবার চুম্বকটা উল্টে ধরতেই ছয়ের বদলে এক উঠতে লাগল। যতবার পরীক্ষা করল ততবার এক। আর যখন চুম্বকটা নিচে রাখে না তখন এই ছক্কাটা পুরোপুরি স্বাভাবিক একটা ছক্কা। টুনি খুশিতে শাহানাকে জড়িয়ে ধরে তার গালে একটা চুমু দিয়ে বলল, “আপু তুমি একটা জিনিয়াস।”
শাহানা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে গাল মুছে বলল, “একটা ছক্কাকে ইঞ্জিনিয়ারিং করতে জিনিয়াস হতে হয় না!”
.
টুনি তার ম্যাজিক ছক্কাটা নিয়ে যখন নিচে নেমে এসেছে তখন মুনিয়া আর শান্তর মাঝে সেমিফাইনাল খেলা হচ্ছে। অন্য গ্রুপের বিজয়ী হিসেবে মিশু জিতে এসেছে। এখন এই খেলাটিতে মুনিয়া জিতে গেলে সে মিশুর সাথে ফাইনাল খেলবে। সবাই মুনিয়ার পক্ষে, শান্ত নিজেও মুনিয়ার পক্ষে, যদিও সে সেটা কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না। প্রত্যেকবার ছয় ওঠার পর সে আনন্দের ভান করে এমন চিৎকার, চেঁচামেচি, হইচই করতে থাকে যে মনে হয় সে বুঝি লটারিতে লক্ষ টাকা পেয়ে গেছে। মুনিয়াকে জেতানোর জন্যে সে তার পাকা খুঁটিগুলো তাকে খেতে দিচ্ছে কিন্তু প্রত্যেকবার তার একটা খুঁটি কাটা পড়লে সে যেভাবে চিৎকার করে আহাজারি করার ভান করতে থাকে যে দেখে মনে হয় খুঁটি নয় সে নিজেই বুঝি কাটা পড়েছে!
দেখতে দেখতে খেলা শেষ হয়ে গেল, মুনিয়া জিতে গিয়েছে এখন মিশুর সাথে ফাইনাল খেলা হবে। ঝুমু খালা এই মাত্র গরম গরম পিয়াজু ভাজা আর কোল্ড ড্রিংক্স নিয়ে এসেছে। সবাই মিলে সেগুলো খেল, তারপর ফাইনাল খেলা শুরু হলো। ছোট টেবিল ঘিরে দর্শকদের ভিড়, তার মাঝে টুনি তার চুম্বকটা টেবিলের নিচে ধরে উপরে ছক্কাটাকে নাচাতে পারবে।
খেলা শুরু হলো। প্রথম মুনিয়া চালল, একটা তিন উঠেছে। এরপর মিশু, টুনি লক্ষ করল খুব পাকা হাতে সে ছক্কাটা বদলে নিজের দুই নম্বরী ছক্কাটি দিয়ে খেলছে। সত্যি সত্যি ছয় উঠে গেল। সবাই একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করল, শুধু টুনি শান্তভাবে বসে রইল, তার ভেতরে কোনো দুর্ভাবনা নেই। মিশু আরেকবার চালল, এবারে তিন উঠেছে। টুনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিশুর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। স্পষ্ট দেখতে পেল মিশু দুই নম্বরী ছক্কাটা বদলে আবার আগের ছক্কাটি দিয়ে দিয়েছে। টুনি তখন শান্তর দিকে তাকিয়ে ছক্কাটি গায়েব করে দেওয়ার ইঙ্গিত করল।
শান্ত হঠাৎ হুংকার দিয়ে বলল, এই পাজি বদমাশ বেয়াদব ছক্কাটাকে একটা শাস্তি দেয়া দরকার। কত বড় বদমাশ ছক্কা, মুনিয়ার উঠেছে তিন আর মিশু ভাইয়ার বেলায় একটা ছয় আরেকটা তিন! পাজির পা ঝাড়া–”
মিশু বলল, “ছক্কার উপর রাগ হয়ে লাভ নেই। এটা হচ্ছে ভাগ্য।”
শান্ত বলল, “ভাগ্যের খেতাপুড়ি।” তারপর কেউ কিছু বোঝার আগে লুডো বোর্ড থেকে ছক্কাটাকে নিয়ে নিচে ফেলে সেটাকে পা দিয়ে লাথি দিতে থাকল। তাতেও তার রাগ কমল বলে মনে হলো না, তখন কোথা থেকে একটা হাতুড়ি বের করে ছক্কাটাকে এক হাতুড়ির আঘাতে টুকরো টুকরো করে ফেলল।
সবাই এত অবাক হলো যে বলার মতো নয়! প্রমি বলল, “শান্ত! তুই একটা পাগল নাকি? ছক্কাটাকে গুঁড়ো করে ফেললি? টুম্পা বলল, “এখন খেলবে কেমন করে?”
মুনিয়া কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “তাহলে আমরা খেলতে পারব না?”
টুনি বলল, “দুশ্চিন্তার কিছু নাই। আমার কাছে আরেকটা লুডোর সেট আছে সেখান থেকে ছক্কাটা নিয়ে আসি।”
প্রমি বলল, “যা, নিয়ে আয়।”
টুনি বলল, “আমার জায়গাটা যেন কেউ না নেয়।”
প্রমি বলল, “কেউ নেবে না।”
সবাই যখন শান্তর পাগলামো এবং নির্বুদ্ধিতা নিয়ে কথা বলছে টুনি তখন উঠে গেল এবং একটু পরেই ফিরে এলো। ছক্কাটা তার পকেটেই আছে কিন্তু কেউ যেন কিছু সন্দেহ না করে সে জন্যে উঠে গিয়ে ছক্কাটা আনার ভান করতে হলো।