ঝুমু খালার কথা শেষ হবার পর এবারে শুধু হাততালি না, জঙ্গি স্লোগান শোনা গেল, “আমার খালা, তোমার খালা, ঝুমু খালা ঝুমু খালা।”
তারপর দাদি লুডোর বোর্ডের উপর একবার ছক্কাটা চাললেন, খেলার উদ্বোধন হয়ে গেল।
কার সাথে কে খেলবে খুব যত্ন করে সেটা তৈরি করা হয়েছে। তিনবার করে খেলা হবে তার মাঝে যে দুইবার জিতবে সে-ই হচ্ছে বিজয়ী। খেলা শুরু হওয়ার আগে মিশু জিজ্ঞেস করল, “এই লুডু টুর্নামেন্টে কে জিতবে বলে তোমাদের মনে হয়?”
কেউ কিছু বলার আগেই মুনিয়া হাত তুলে বলল, “আমি!”
“তুমি?”
মিশু বলল, “তুমি কেমন করে জানো তুমি চ্যাম্পিয়ন হবে?”
মুনিয়া বলল, “আমি খুব ভালো লুডো খেলতে পারি। আর আমি যখন চ্যাম্পিয়ন হব তখন আমি একশ টাকা পাব। আমার একশ টাকা দরকার।”
“এত ছোট মানুষ তুমি এত টাকা দিয়ে কী করবে?”
মুনিয়া মাথা নাড়ল, বলল, “বলব না।”
মিশু বলল, “মুনিয়া তুমি কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হবে না। শুধু শুধু আশা করে বসে থেকো না।”
মুনিয়া ভয় পাওয়া গলায় বলল, “হব না?”
“নাহ্। চ্যাম্পিয়ন হব আমি। আমাকে কেউ হারাতে পারবে না।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ সত্যি।” মিশু মাথা নাড়ল, “লুডো খেলার মাঝে আমি হচ্ছি সারা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে বড় এক্সপার্ট। আমাকে কেউ হারাতে পারবে না।”
মুনিয়ার ছোট মুখটা একটু কালো হয়ে যায়। টুনি মুনিয়াকে সাহস দিয়ে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই মিশু মুনিয়াকে বলল, “কিন্তু তোমার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমি তোমাকে আগেই তোমার জন্যে একশ টাকা বের করে দেব।”
মুনিয়া অবাক হয়ে বলল, “কোথা থেকে বের করবে।” “তোমার কাছেই আছে।” “আমার কাছে আছে?”
মিশু বলল, “হ্যাঁ। এই দেখো” বলে মুনিয়ার কানটা স্পর্শ করে পাঁচ টাকার একটা কয়েন বের করে আনে। সেটা দেখে মুনিয়ার মুখটা হাঁ হয়ে গেল। তার কানের ভেতর পাঁচ টাকার এত বড় একটা কয়েন আছে সে কখনো জানত না।
মিশু বলল, “কয়েনগুলো রাখার জন্যে কিছু একটা দরকার।” দেখা গেল সে রেডি হয়ে এসেছে। কফি টেবিলের উপর রাখা একটা খালি কৌটা নিয়ে সেখানে ঝন করে পাঁচ টাকার কয়েনটা. ফেলে আবার মুনিয়ার অন্য কান থেকে আরেকটা পাঁচ টাকার কয়েন বের করে আনে। তারপর নাক থেকে দুইটা কয়েন বের করে আনে। চোখ থেকে, চুল থেকে, ঘাড় থেকে কয়েন বের হতে থাকে আর মিশু কয়েনগুলো টিনের কৌটার মাঝে রাখতে থাকে। যখন মুনিয়ার শরীর থেকে বিশটা পাঁচ টাকার কয়েন বের হয়েছে
তখন মিশু বলল, “এই যে মুনিয়া একশ টাকা হয়ে গেছে। তোমাকে তোমার একশ টাকা দিয়ে দিই। সব কৌটার মাঝে জমা করে রেখেছি।”
মুনিয়া ব্যাপারটা বিশ্বাস করবে কী না বুঝতে পারছে না। কিন্তু অবিশ্বাসই বা করে কেমন করে? নিজের চোখে দেখেছে মিশু ভাইয়া তার কান থেকে, নাক থেকে কয়েনগুলো বের করছে। সে টুনির দিকে তাকাল, টুনি বলল, “মিশু ভাইয়ার কথা বিশ্বাস করিস না। এগুলো ম্যাজিক। হাতের কারসাজি। তোর সাথে ঠাট্টা করছে।”
মিশু গম্ভীর মুখে বলল, “মোটেও কারসাজি না। এই দেখো কয়েনগুলো কৌটার মাঝে আছে।” মিশু কৌটাটা ঝাঁকুনি দিতেই ভেতরে কয়েনগুলো ঝনঝন করে উঠল। তারপর কৌটার মুখে তার প্রাস্টিক ঢাকনাটা লাগিয়ে কৌটাটা তাকে দিয়ে বলল, “নাও। তোমার জন্যে।”
মুনিয়া আগ্রহ নিয়ে কৌটাটা নিল। মিশু বলল, “শুধু মুখটা খোলার সময় সাবধান।”
“কেন?”
“এটা খোলার সময় তুমি যেটা ইচ্ছা চিন্তা করতে পারো কিন্তু হাতির কথা চিন্তা করতে পারবে না। হাতির কথা চিন্তা করলেই কিন্তু কয়েনগুলো ভ্যানিশ হয়ে যাবে।”
“ভ্যানিশ হয়ে যাবে?”
“হ্যাঁ।”
মুনিয়া কয়েকবার কৌটার মুখটা খুলতে গিয়ে থেমে গেল। প্রত্যেকবার খোলার সময় তাকে নিশ্চিত হতে হয় সে যে হাতির কথা চিন্তা করছে না, তখন হাতির কথা মনে পড়ে যায়।
টুনি মুনিয়ার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “মিশু ভাইয়া তোকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে। এই কৌটার ভিতরে কিছু নেই। তুই খুলে দেখ।”
মুনিয়া শেষ পর্যন্ত কৌটাটা খুলে চিৎকার করে সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। ভিতরে একটা মরে শুকনো হয়ে থাকা টিকটিকি। কী ভয়ানক! একটু আগে শান্তর ঘরে জানালার ফাঁকে আটকে পড়ে মরে পড়ে থাকা এই টিকটিকিটা মিশু আবিষ্কার করে এখনই একটা কাজে লাগিয়ে দিয়েছে!
মিশু দুলে দুলে হাসতে হাসতে বলল, “তুমি নিশ্চয়ই কৌটা খোলার সময় হাতির কথা চিন্তা করেছ তাই সব কয়েন ভ্যানিশ করে একটা মরা টিকটিকি চলে এসেছে!”
মুনিয়া বিষদৃষ্টিতে মিশুর দিকে তাকিয়ে রইল।
.
কিছুক্ষণের ভিতরে লুডো টুর্নামেন্ট শুরু হয়। মিশু ঘোষণা দিয়ে রেখেছে কেউ তাকে খেলায় হারাতে পারবে না। দেখা গেল তার কথা সত্যি। সে অবলীলায় প্রথম খেলাটা জিতে গেল। মনে হলো ছক্কাটা তার কথা শুনে, যখনই ছয়ের দরকার হয় একটা ছয় উঠে আসে। লুডো খেলায় এ রকম ছয়ের ছড়াছড়ি সে আগে দেখেনি!
দ্বিতীয় খেলার সময়ও দেখা গেল ঝটপট মিশুর সব খুঁটি বোর্ডে উঠে এসেছে, তারপর দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। টুনি তখন মিশুর খেলাটা ভালো করে লক্ষ করল এবং মিশুর জিতে যাওয়ার কারণটা কিছুক্ষণের মাঝেই আবিষ্কার করে ফেলল।
মিশুর কাছে দ্বিতীয় একটা ছক্কা আছে যেটা দেখতে হুবহু আসল ছক্কার মতোন। কিন্তু সেই ছক্কাটিতে কোনো পাঁচ নেই, পাঁচের বদলে সেখানে আরো একটি ছয় আছে। এই ছক্কাটি দিয়ে খেললে ছয় ওঠার সম্ভাবনা বেড়ে ডাবল হয়ে যায়। মিশুর যখন ছয়ের দরকার হয় সে এটা দিয়ে খেলে। মিশু যেহেতু ম্যাজিক দেখায়, তার হাতসাফাই অসাধারণ। হাতের মাঝের লুকিয়ে রাখা ছক্কাটা কেমন করে বদলে দেয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেও ধরা যায় না। ছক্কাটা যখন গড়িয়ে যায় তখন খুব ভালো করে তাকালে বোঝা যায় এই ছক্কার দুই পাশেই ছয়। টুনি মিশুকে ধরিয়ে দিবে কী না চিন্তা করল, কিন্তু মিশুর মতো ধুরন্ধর ছেলেকে শুধু ধরিয়ে দিলে হবে না, তাকে একটা শিক্ষাও দেয়া দরকার। টুনি তখন লুডো টুর্নামেন্ট থেকে উঠে উপরে গেল। শাহানা আপু ভরসা। যখন তার নিজের বুদ্ধিতে কুলায় না তখন সে শাহানা আপুর বুদ্ধি ধার নেয়।