শান্ত মাথা নাড়ল, বলল, “রেডি।”
“তাহলে ঐ দেয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়াও। ডান পায়ের ডান সাইডটা দেয়ালে লাগিয়ে বাম পাটা এক সেকেন্ডের জন্যে উপরে তুলবে। বেশি না, মাত্র এক সেকেন্ড!”
শান্ত হাসি হাসি মুখে গেল, ডান পায়ের ডান দিকের অংশটা দেয়ালের সাথে লাগাল এবং হঠাৎ করে সবাই দেখল শান্তর মুখটা কেমন যেন চিমশে মেরে গেল। মনে হচ্ছে ডান পায়ের উপর ভর দিয়ে সে বাম পাটা তুলতে পারছে না! এক সেকেন্ডের জন্যেও না! কী আশ্চর্য!
মিশু বলল, “কী হলো দাঁড়িয়ে আছ কেন? তোলো বাম পা, ডান পায়ের উপর দাঁড়াও।”
শান্ত বোকার মতো একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “পারছি না!” তারপর শেষ চেষ্টা হিসেবে একটুখানি তুলে সাথে সাথে নামিয়ে ফেলল, বোঝাই যাচ্ছে সে দেয়ালের সাথে এক পা এবং শরীর লাগিয়ে অন্য পা তুলতে পারবে না।
মিশু হাত পেতে বলল, “দাও আমার দশ টাকা।”
শান্ত মুখটা কালো করে পকেট থেকে দশ টাকার একটা নোট বের করে মিশুকে দিল। টাকাটার জন্যে তার খুব দুঃখ নেই কিন্তু সবার সামনে সে যে বোকা বনেছে সে জন্যে তার খুবই লজ্জা লাগছিল।
শান্তর অবস্থা দেখে অন্য সবাই চেষ্টা করে আবিষ্কার করল দেয়ালের সাথে পা এবং শরীর লেগে গেলে কোনোভাবেই এক পায়ে দাঁড়ানো যায় না। মিশু মুখ গম্ভীর করে বলল, “পারবে না। এটা সম্ভব না। এক পায়ে দাঁড়ালে শরীরের সেন্টার অব গ্রেভিটি ব্যালেন্স করার জন্যে শরীরটা বাকাতে হয়। দেওয়াল থাকলে শরীর বাকানো যায় না, তাই এক পায়ে দাঁড়ানোও যায় না।”
মিশুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা শুনেও কেন জানি কেউই খুব চমৎকৃত হলো না।
.
রাতে ঘুমানোর সময় মিশু শান্তকে জীবন সম্পর্কে একটু জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করল। বলল, “বুঝলে শান্ত, বেশি ভালো মানুষ হয়ে লাভ নাই। দুনিয়ায় টিকে থাকতে হলে ঠিক জায়গায় দুই নম্বরি করতে হয়।”
শান্ত উঠে বসল, “তুমি দুই নম্বরি করো?”
“করি না? সব সময় করি। করতে হয়। যেমন–মনে করো পরীক্ষার সময় তুমি খুব ভালো পরীক্ষা দিলে, কিন্তু অন্যরা তোমার থেকেও ভালো পরীক্ষা দিল, তাহলে তোমার লাভ কী? তাই পরীক্ষার সময় তোমার ভালো পরীক্ষা দেওয়া যেমন দরকার, অন্যদের পরীক্ষা খারাপ করে দেওয়া সমান। দরকার।”
“অন্যদের পরীক্ষা তুমি কেমন করে খারাপ করবে?”
“অনেক রকম উপায় আছে। তোমাকে সোজা একটা উপায় শিখিয়ে দেই। ক্যালকুলেটরে ডিগ্রি থাকে আর রেডিয়ান থাকে। ছেলেমেয়েরা সবসময় ডিগ্রিতে হিসাব করে। আমি কী করি জানো?”
“কী করো?”
“ওদের ক্যালকুলেটর নিয়ে সেটাকে রেডিয়ানে সেট করে দেই। তারা তো আর সেইটা জানে না, তাই যখন ত্রিকোণমিতি করে সব হিসাব তখন ভুল হয়ে বের হয়। পরীক্ষায় এত বড় গোল্লা পায়–” কথা শেষ করে মিশু আনন্দে হা হা করে হাসতে থাকে।
শান্ত ঠিক বুঝতে পারছিল না অন্যদের পরীক্ষায় গোল্লা পাইয়ে দেওয়াটা ঠিক কাজ হচ্ছে কি না। কিন্তু কেউ তো অস্বীকার করতে পারবে না মিশু ভাইয়া খুবই ভালো ছাত্র, ভর্তি পরীক্ষায় সবগুলো ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে। কাজেই সে যে কাজগুলো করে সেটা নিশ্চয়ই সঠিক কাজ। তবু তার ভিতরে খচখচ করতে থাকে।
.
পরদিন লুডো টুর্নামেন্ট শুরু হলো। ছোট একটা টেবিলের দুই পাশে দুটি চেয়ার, সেখানে খেলোয়াড়রা বসবে। টেবিলে লুডোর বোর্ড। টেবিল ঘিরে দর্শকেরা বসে কিংবা দাঁড়িয়ে চিৎকার করে খেলোয়াড়দের উৎসাহ দেবে। অনেক কষ্ট করে একশ টাকা জোগাড় করা হয়েছে। টুর্নামেন্টের বিজয়ীকে এই একশ টাকা নগদ দেয়া হবে। টুর্নামেন্টের উদ্বোধন করার জন্যে দাদি (কিংবা নানি)-কে ধরে আনা হলো, দাদির সাথে ঝুমু খালাও চলে এসেছে। প্রথমে দাদিকে বলা হলো একটা বক্তৃতা দিতে। দাদি অবাক হয়ে বললেন, “বক্তৃতা? আমি?”
সবাই মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। হ্যাঁ, তুমি।”
দাদি বললেন, “আমি কখনো বক্তৃতা দেই নাই। কেমন করে বক্তৃতা দিতে হয় জানি না।”
শান্ত বলল, “বক্তৃতা কেমন করে দিতে হয় কেউ জানে না! শুধু হাত উপরে তুলে গলা কাঁপিয়ে বলল, ধ্বংস হোক, ধ্বংস হোক।”
দাদি অবাক হয়ে বললেন, “ধ্বংস হোক? কে ধ্বংস হবে?”
“সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। মেহনতি মানুষের শত্রু-এইসব।”
প্রমি শান্তকে ধমক দিয়ে বলল, “তুই চুপ করবি?” তারপর দাদির দিকে তাকিয়ে বলল, “লুডো খেলা নিয়ে কিছু একটা বলো।”
দাদি তখন গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “মুনিয়া বেচারি লুডো খেলতে চাচ্ছিল, তোরা কেউ আগে খেলতে চাস নাই সে জন্যে মুনিয়ার মন খুব খারাপ ছিল। এখন তোরা খেলার আয়োজন করেছিস দেখে খুশি হলাম। দোয়া করি তোদের প্রতি দানে যেন বেশি করে ছক্কা ওঠে।”
দাদির বক্তৃতা শেষ হতেই সবাই জোরে জোরে হাততালি দিল। তখন প্রমি ঝুমু খালাকে বলল, “ঝুমু খালা এখন তুমি একটা বক্তৃতা দাও।”
ঝুমু খালা এক কথায় রাজি। শাড়িটা কোমরে প্যাচিয়ে হাত নেড়ে বক্তৃতা শুরু করে দিল, “দেশবাসী ভাই-বোনেরা আপনাদের লাল সালাম (প্রচণ্ড হাততালি শোনা গেল)। এই বাসার পুলাপান কিছু পাগল কিছু আধা পাগল (আবার হাততালি) তারপরেও তোমরা একটা লুডু খেলার আয়োজন করেছ, সেই জন্যে লাল সালাম (আবার হাততালি)। আমি এইখানে ঘোষণা দিয়ে গেলাম লুডু খেলা চলার সময় আমি ঘণ্টায় ঘণ্টায় তোমাদের চা-নাস্তা দিয়ে যাব।”