শুধু দাদি বললেন, “আহা বেচারা গরিব মানুষ। একটা পেপার চুরি করে আর কত পয়সাই বা পায়! নিতে চায় নিয়ে যাক!”
শান্ত চিৎকার করে বলল, “দাদি তুমি কী বললে? চোর চুরি করতে চাইলে চুরি করবে? বাসার দরজা খোলা রেখে সাইনবোর্ড লাগাব, চোর ভাইয়েরা, আসেন! চুরি করেন!”
শান্তর কথা শুনে বেশ কয়েকজন খুব আনন্দ পেল; তারা হা হা হি হি করে হাসতে লাগল। শান্ত রেগেমেগে বলল, “তোরা কি ভাবছিস আমি ঠাট্টা করছি?”
দাদি বললেন, “তোদের হয়েছেটা কী? একটা পেপার নিয়ে এত হইচই? এমন তো না যে কোহিনুর হীরা চুরি গেছে।”
ছোটদের মাঝে সবচেয়ে জ্ঞানী শাহানা বলল, “কোহিনুর হীরা চুরি গেলে কিছু করার থাকে না দাদি। ব্রিটিশেরা কোহিনুর হীরা চুরি করে নিয়ে গেছে না?”
প্রায় সবাই চোখ বড় বড় করে বলল, “তাই নাকি? কখন? কীভাবে? কোথায়? পুলিশ ধরে নাই?”
শাহানা বিরক্ত হয়ে বলল, “বহু দিন আগে। ব্রিটিশ আমলে, নিয়ে তাদের মিউজিয়ামে রেখে দিয়েছে।”
“তাই বল।”
একসাথে সবাই কোহিনুর হীরা চুরি নিয়ে কৌতূহল হারিয়ে ফেলল। সবাই আবার পেপার চুরিতে ফিরে এলো। শান্ত মুখ সুচালো করে বলল, “কীভাবে চোরটাকে ধরা যায় বল দেখি।”
দাদি বলল, “চোর ধরতে হবে না। একটা চিঠি লিখে টানিয়ে রেখে দে।”
“চিঠি?”
“হ্যাঁ।”
শান্ত মুখ শক্ত করে বলল, “চিঠিতে কী লিখব?”
“মানুষটাকে অনুরোধ করবি, পেপার চুরি না করার জন্যে। লিখবি Iাকার দরকার থাকলে বলতে, দশ-বিশ টাকা দিয়ে দেব।” কথা শেষ করে দাদি ঝুমু খালার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তাই না ঝুমু?”
দাদি যেটাই বলে ঝুমু খালা সেইটা সব সময় মেনে নেয়। একটু আগে ঝুমু খালা চোরকে ঝাড়পেটা করতে চেয়েছিল এখন দাদির সাথে সুর মিলিয়ে বলল, “আহা! গরিব মানুষ। টাকার কষ্ট অনেক বড় কষ্ট। ভালো করে মায়া করে একটা চিঠি লিখলেই আর চুরি করবে না।”
বসার ঘরে যারা ছিল তারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। এক ভাগ বলল, চিঠি লিখলে সেই চিঠি পড়ে চোর আর পেপার চুরি করবে না। অন্য ভাগ বলল, চিঠি লিখে কিছুতেই চোরকে পেপার চুরি বন্ধ করানো যাবে না। চোর চোরই থেকে যাবে।
এই বাসায় সবাই অবশ্যি সবসময় দাদির (কিংবা নানির) সব কথা শুনে, তাই এইবারও দাদির কথা শোনা হলো। একটা কাগজ এনে সেখানে মোটা মোটা অক্ষরে লেখা হলো :
প্রিয় পেপার চোর মহোদয়।
আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা গ্রহণ করিবেন। আমরা অত্যন্ত দুঃখ এবং বেদনার সহিত লক্ষ করিতেছি যে, গত কিছুদিন যাবৎ আপনি নিয়মিতভাবে আমাদের পেপার চুরি করিতেছেন। অনুগ্রহ করিয়া পেপার চুরি বন্ধ করিবেন, কারণ আমাদের অনেকেই শুধু যে পেপার পড়িতে না পারিয়া দেশ, সমাজ এবং জাতি সম্পর্কে তথ্য হইতে বঞ্চিত হইতেছে তাহা নহে, পেপার না পড়িতে পারিয়া মানসিকভাবে ভাঙিয়াও পড়িতেছে।
উল্লেখ্য যে, যদি আপনি কোনো প্রকার অর্থকষ্টের কারণে এই কার্য করিতে বাধ্য হইয়া থাকেন তাহা হইলে আপনি আমাদের সহিত যোগাযোগ করুন। আমরা আপনাকে সাহায্য করিতে প্রস্তুত।
বিনীত
এই বাসার সকল সদস্যবৃন্দ।
শান্ত এই চিঠিটা নিচে দরজার উপর লাগিয়ে দিতে নিয়ে গেল। চিঠিটা লাগানোর আগে সে নিচে আরো একটা লাইন যোগ করল। লাইনটি এ রকম :
বিশেষ দ্রষ্টব্য : বান্দরের বাচ্চা বান্দর, তোরে যদি ধরতে পারি পিটিয়ে তোর ঠ্যাঙ ভেঙে দিব। খোদার
কসম! পেপার চুরি বন্ধ করার এই পুরো ব্যাপারটা সম্পর্কে অবশ্যি ছোটাচ্চু সেদিন কিছুই জানতে পারল না। ছোটাচ্চুর আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির কাজের চাপ অনেক বেশি, মাঝে মাঝেই তার বাসায় আসতে অনেক রাত হয়ে যায়। আজকেও তাই হয়েছে।
ছোটাচ্চু ঘটনাটা জানতে পারল পরের দিন, যখন চিঠিটা টানিয়ে দেবার পরও পেপার চোর পরের দিনের পত্রিকাটাও চুরি করে নিয়ে গেল!
বসার ঘরে তখন দাদি (কিংবা নানি) ঝুমু খালাকে নিয়ে সিরিয়াল দেখছেন। সেখানে সাজুগুজু করে থাকা একজন পুরুষ মানুষ সাজুগুজু করে থাকা আরেকজন মহিলাকে নাকি গলায় কিছু একটা বলছে, যেটা শুনে ঝুমু খালার চোখ ছলছল করছে। বড় চাচা (কিংবা বড় মামা) অন্যমনস্কভাবে একটা বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছেন। চাচি, খালা, মামা এবং অন্যেরা চা খাচ্ছেন কিংবা নিজেদের মাঝে রাজনীতি নিয়ে তর্ক করছেন। বাচ্চারা তাদের লেখাপড়া, হোমওয়ার্ক শেষ করে (কিংবা শেষ না করেই) বসার ঘরের মেঝেতে শুয়ে-বসে একজন আরেকজনকে জ্বালাতন করছে।
এই সময় ছোটাচ্চু ঘরে ঢুকলেন। তার হাতে একটা বড় কেক আর সেটা দেখে বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করে উঠল। ছোটাচ্চু হাসি হাসি মুখে বলল, “আজুকে ড্রাগ বাস্টিং কেসের বিল পেয়েছি, তাই ভাবলাম সবাই মিলে খাওয়ার জন্যে একটা কেক নিয়ে আসি।”
শান্ত বলল, “শুধু কেক?”
ছোটাচ্চু থতমত খেয়ে বলল, “আর কী চাস?”
শান্ত বলল, “আমাদেরকে চায়নিজ খেতে নিয়ে যাও।”
আরেকজন বলল, “ধুর, চায়নিজ খেয়ে মজা নাই। পিঞ্জা খেতে নিয়ে যাও।”
আরেকজন বলল, “দুইটাই খাওয়া যায়।”
আরেকজন বলল, “তারপর আইসক্রিম–”
খাওয়া-দাওয়া নিয়ে আলোচনা চলতে থাকত কিন্তু তখন টুনি বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি জানো আমাদের বাসা থেকে প্রত্যেক দিন পেপার চুরি হয়ে যাচ্ছে?”
ছোটাচ্চু হাসতে হাসতে বলল, “তাই নাকি?” তারপর তার অফিসে কী হয়েছে সেটা নিয়ে কথা বলতে থাকল। মনে হলো পেপার চুরির ঘটনাটা বুঝি কোনো ঘটনাই না!