আইরিন জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “কিছু হয় নাই আম্মু। কিছু হয় নাই।”
“রাতে ঘুম হয়েছে?”
“হ্যাঁ আম্মু হয়েছে। শুধু”
“শুধু কী?”
“শুধু সারারাত স্বপ্ন দেখেছি।”
“কী স্বপ্ন দেখেছিস?”
“পরীক্ষা হচ্ছে আর আমি কোনো উত্তর মনে করতে পারছি না। তখন–”
“তখন কী?”
“কলম দিয়ে যেটাই লিখি লেখা হয় গোল্ডেন ফাইভ। আমি কাগজের পাতায় শুধু লিখছি গোল্ডেন ফাইভ গোল্ডেন ফাইভ–”
আম্মু মুখ কালো করে বললেন, “গোল্ডেন ফাইভ নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার কী আছে?”
“ঠিকই বলেছ আম্মু।”
আইরিন বলল, “এত বাড়াবাড়ি করার কিছু নাই। কিন্তু–”
“কিন্তু কী?”
“আমি যেদিকে তাকাই সেদিকেই দেখি লেখা আছে গোল্ডেন ফাইভ।”
আইরিন মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাল, তারপর বলল, “না আম্মু, এখন দেখছি না।”
আম্মু বললেন, “না দেখলেই ভালো।”
.
আইরিন স্কুলে যাবার পর আম্মু তার ঘরে গিয়ে চমকে উঠলেন, সারা দেওয়ালে মার্কার দিয়ে লেখা, গোল্ডেন ফাইভ! গোল্ডেন ফাইভ!
হঠাৎ করে আম্মু কেমন জানি অসুস্থ বোধ করতে থাকেন। মনে হতে থাকে মেয়েটাকে চাপ দিয়ে বুঝি তার একটা বড় সর্বনাশ করে ফেলেছেন। আইরিনের বিছানায় বসে আম্মু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন।
রাত্রে ছোটাচ্চু টুনিকে বললেন, “টুনি তোর মনে আছে তোকে আইরিন নামে একটা মেয়েকে ওয়াচ করার জন্যে একটা কোচিং সেন্টারে পাঠিয়েছিলাম?”
“মনে আছে ছোটাচ্চু।”
“সেই মেয়েটার খুব সিরিয়াস সমস্যা।” টু
নিকে খুব দুশ্চিন্তিত মনে হলো না। বলল, “কী সমস্যা?”
“মনে হচ্ছে আস্তে আস্তে নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়ে যাচ্ছে?”
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ। তার মা আমাকে ফোন করেছিল। মেয়েটার ভয়াবহ অবস্থা।”
“কেন? কী করে?”
“প্রথমে দিন-রাত শুধু অঙ্ক মুখস্থ করত। তারপর দেখা গেল ঘুমাতে পারে না। তারপর–”
টুনি হাত তুলে বলল, “দাঁড়াও, আমি বলি। তারপর সারা রাত লাইট জ্বালিয়ে সারা বাসায় বই মুখস্থ করতে করতে ঘুরে বেড়ায়। স্কুলের পোশাক পরে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। রাত্রেবেলা বড় ডেকচিতে ভাত রান্না করে, ঘরের দেওয়ালে লিখে রাখে গোল্ডেন ফাইভ! গোল্ডেন ফাইভ! গোল্ডেন ফাইভ!”
ছোটাচ্চু হাঁ করে টুনির দিকে তাকিয়ে রইলেন, কয়েকবার চেষ্টা করে বললেন, “তু-তু-তুই কেমন করে জানিস?”
“কারণ এইটা হচ্ছে প্ল্যান এ। এরপর আইরিন সবকিছু ভুলে যেতে শুরু করবে। কাউকে চিনবে না। আরো আছে। শুনতে চাও?”
“তার মানে আইরিনের আসলে কিছু হয়নি! পুরোটা অভিনয়?”
টুনি মাথা নাড়ল, “পুরোটা প্ল্যান এ। সে নিজে যেটা প্ল্যান করেছিল সেটা অনেক ডেঞ্জারাস। সেটা এখন প্ল্যান বি। অনেক বুঝিয়ে তাকে প্ল্যান এ’তে রাজি করিয়েছি। যদি এই প্ল্যান কাজ করে তাহলে প্ল্যান বি’তে যেতে হবে না। বুঝেছ?”
ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলল, “তুই ভয়ঙ্কর ডেঞ্জারাস!”
“না ছোটাচ্চু আমি ডেঞ্জারাস না। তোমরা–বড় মানুষেরা হচ্ছ। ডেঞ্জারাস।”
“তুই কেমন করে এটা করলি? বেচারি মায়ের অবস্থা কী তুই জানিস? হাউমাউ করে কাঁদছে।”
টুনি মুখ শক্ত করে বলল, “তুমি সব ঠিক করে দাও। মা’কে বোঝাও যেন আর কখনো গোল্ডেন ফাইভের জন্যে চাপ না দেয়। বোঝাও যেন আইরিনকে নিজের মতো করে লেখাপড়া করতে দেয়, গল্পের বই পড়তে দেয়, প্রাইভেট কোচিং থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে। বোঝাও তাহলে আইরিন ঠিক হয়ে যাবে।”
ছোটাচ্চু তখনো হাঁ করে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। আবার বিড়বিড় করে বলল, “টুনি! তুই সাংঘাতিক ডেঞ্জারাস।”
টুনি কথা না শোনার ভান করে বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি এখনই আইরিনের আম্মুকে ফোন করো। এক্ষুনি।”
ছোটাচ্চু ফোনটা হাতে নিয়ে বলল, “ঠিক আছে করছি।”
.
দুই দিন পর সবাই বসার ঘরে বসে আছে, দাদি (কিংবা নানি) টেলিভিশনে বাংলা সিরিয়াল দেখছেন। বড় চাচা খবরের কাগজ পড়ছেন। কয়েকজন চাচি-খালা রাজনীতি নিয়ে তর্ক করছেন, ঝুমু খালা ডালপুরী ভেজে এনেছে, বাচ্চারা সেগুলো কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে, ঠিক তখন ছোটাচ্চু বিশাল একটা কেক নিয়ে হাজির হলো। বাচ্চারা আনন্দে হই হই করে উঠল। কেকটা নিয়ে টানাটানি করতে থাকল। একজন বলল, “থ্যাংকু ছোটাচ্চু, থ্যাংকু!”
ছোটাচ্চু বলল, “আমাকে থ্যাংকু দিতে হবে না। থ্যাংকু যদি দিতে চাস আমার একজন ক্লায়েন্টকে থ্যাংকু দে। আইরিন নামে একটা মেয়ের মা এই কেকটা নিয়ে এসেছে।”
কেকটাকে বাক্স থেকে বের করতে করতে একজন জিজ্ঞেস করল, “কেন কেক এনেছে আইরিনের মা?”
“লেখাপড়ার প্রচণ্ড চাপে মেয়েটার নার্ভাস ব্রেক ডাউনের মতো হয়েছিল। আমি তখন মাকে কয়েকটা আইডিয়া দিলাম, সেই আইডিয়া মতো কাজ করার পর মেয়েটা পুরোপুরি ভালো হয়ে গেছে!”
আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “কী আইডিয়া দিয়েছিলে ছোটাচ্চু?”
“পড়াশোনার কোনো চাপ না দিতে। যেটা পছন্দ করে সেটা করতে দিতে। বইয়ের দোকানে গিয়ে অনেকগুলো গল্পের বই কিনে সেগুলো পড়তে দিতে, প্রাইভেট কোচিং এসব থেকে সরিয়ে নিতে। এই রকম কয়েকটা আইডিয়া।”
শান্ত বলল, “এইগুলো তো সবাই জানে-আমিও দিতে পারতাম।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “আইরিনের মা সবগুলো আইডিয়া শুনেছে?”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “সব। মেয়েটাকে নিয়ে অফিসে এসেছিল। হাসি-খুশি সুইট একটা মেয়ে। তোর মতো বড় বড় চশমা। হাতে মোটা একটা বই।”