আইরিন কেমন যেন ভয়ানকভাবে চমকে উঠে ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী? কী? কী হয়েছে? কী হয়েছে আম্মু?”
আম্মু বললেন, “খেতে ডাকছি, শুনিসনি?”
“না আম্মু, অঙ্কটা মুখস্থ করছিলাম। শুনি নাই।”
“পরে মুখস্থ করবি। আয় খেতে আয়।”
আইরিন উঠে দাঁড়াল, তারপর অনেকটা রবোটের মতো হেঁটে হেঁটে খাবার টেবিলে গিয়ে পিঠ সোজা করে বসে রইল। চোখটা আধ-খোলা, ঠোঁট নড়ছে, কিছু একটা বিড়বিড় করে বলছে।
আম্মু আর আব্বু অবাক হয়ে আইরিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আব্বু বললেন, “খেতে বসেছিস, এখন খা, মা।”
আইরিন বলল, “খাব আব্বু।”
আম্মু প্লেটে ভাত দিলেন। আইরিন ভাতগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল, একটা একটা করে ভাত গুনতে লাগল।
আম্মু জিজ্ঞেস করলেন “কী করিস?”
আইরিন গোনা থামিয়ে বলল, “কিছু করি না।”
আম্মু প্লেটে সবজি দিলেন। একটা বড় পাবদা মাছ দিলেন, আইরিনের পছন্দের মাছ। আইরিন সবজি দিয়ে ভাত খেয়ে মাছটা খেতে গিয়ে থেমে গেল। মাথা নিচু করে প্লেটের সাথে প্রায় মাথাটা ছুঁইয়ে মাছের মাথাটার দিকে তাকিয়ে রইল। আম্মু ধমক দিয়ে বললেন, “কী করিস?”
“দেখো আম্মু। মাছটা কেমন করে তাকিয়ে আছে দেখেছ?”
আম্মু আবার ধমক দিয়ে বললেন, “মাছ আবার তাকিয়ে থাকে কেমন করে? খেতে বসেছিস খা।”
আইরিন মাছটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ মাথাটার দিকে তাকিয়ে রইল, ডানে-বামে মাথাটা নাড়াল, তারপর খেতে শুরু করল। আম্মু ধমক দিলেন, বললেন, “ঢং করবি না। ঠিক করে খা।”
আব্বু বললেন, “আহ্, কেন বকছ! মেয়েটাকে খেতে দাও।”
আইরিন খাওয়া শেষ করে আবার টেবিলে বসে দুলে দুলে অঙ্ক মুখস্থ করতে লাগল। রাত বারোটার সময় আম্মু এসে দেখলেন তখনো আইরিন গুনগুন করে কিছু একটা পড়ছে। আম্মু নরম গলায় বললেন, “যা, এখন ঘুমাতে যা।”
আইরিন বলল, “আর দুইটা অঙ্ক মুখস্থ করে নিই আম্মু।”
আম্মু বললেন, “এখন ঘুমা, অনেক সকালে উঠতে হবে।”
“তাহলে আরেকটা অঙ্ক মুখস্থ করি? মাত্র একটা?”
“না। এখন ঘুমা।”
“পরে যদি গোল্ডেন ছুটে যায়?” কথা শেষ করে আইরিন কেমন জানি শিউরে উঠল।
আম্মু বললেন, “এখন ঘুমা।”
আইরিন তখন বাধ্য মেয়ের মতো ঘুমাতে গেল। এক দিনের জন্যে যথেষ্ট হয়েছে।
.
পরের দিন স্কুল থেকে এসে আইরিন ব্যাগটা ঘরে রেখে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে রইল। আম্মু এসে বললেন, “কী হয়েছে? শরীর খারাপ?
“না আম্মু। একটু মনে মনে রিভিশন দিচ্ছি।”
“যা, গোসল করে খেতে আয়।”
আইরিন উঠে বাথরুমে গেল এবং আম্মু সাথে সাথে শাওয়ারের শব্দ শুনতে পেলেন। আম্মু অবাক হয়ে সাবধানে বাথরুমের দরজায় উঁকি দিলেন, দেখলেন স্কুলের পোশাক পরে আইরিন শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ঝরঝর করে পানি তার চুল মাথা বেয়ে কাপড় ভিজিয়ে পড়ছে। আম্মু অবাক হয়ে বললেন, “কী করছিস তুই? কী করছিস?”
আইরিন জানতে চাইল, “কী করছি?”
“স্কুল ড্রেস পরেই গোসল করছিস?”
আইরিন অবাক হয়ে নিজের দিকে তাকাল, তারপর জিভে কামড় দিয়ে বলল, “হায় হায়! কী বোকা আমি!”
আইরিন শাওয়ার থেকে বের হয়ে তার হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। আম্মু দেখলেন তার হাতে মার্কার দিয়ে লেখা গোল্ডেন ফাইভ! অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হলো, হাতে গোল্ডেন ফাইভ লিখেছিস কেন?”
“যেন ভুলে না যাই। গোল্ডেন ফাইভ পেতেই হবে। তাই না আম্মু?”
আম্মু দুর্বল গলায় বললেন, “হ্যাঁ। পেতে হবে।”
আইরিন গলা উঁচিয়ে বলল, “পেতে হবে না। পেতেই হবে।”
আইরিনের পরিবর্তনটা খুবই স্পষ্ট। সারাক্ষণই বিড়বিড় করে কিছু একটা মুখস্থ করছে। কথা বললে একেবারে শুনতে পায় না। কয়েকবার ডাকাডাকি করলে হঠাৎ শুনতে পায় এবং তখন ভীষণভাবে চমকে ওঠে। খেতে বসলে অন্যমনস্কভাবে খেতেই থাকে। রাতে ঘুমায় না। বাসায় সব আলো জ্বালিয়ে হাতে একটা বই নিয়ে মুখস্থ করতে করতে সারা ঘরে ঘুরে বেড়ায়। বিড়বিড় নিজের মনে কথা বলে। একদিন গভীর রাতে রান্নাঘরে টুকটাক শব্দ শুনে আম্মু গিয়ে দেখেন বিশাল একটা ডেকচিতে পানি চাপিয়ে আইরিন সেখানে চাল দিয়ে পানি গরম করছে। আম্মু অবাক হয়ে বললেন, “কী করছিস আইরিন?”
“ভাত রান্না করছি।”
“কেন?”
প্রশ্নটা শুনে আইরিন খুব অবাক হয়ে গেল, বলল, “কেন আম্মু? ভাত রান্না করতে হবে না?”
আম্মু বললেন, “না তোকে ভাত রান্না করতে হবে না। ঘুমুতে যা।”
আইরিন বলল, “ঘুমাতে পারি না আম্মু।”
“ঘুমাতে পারিস না?”
“না, ঘুমালেই স্বপ্ন দেখি পরীক্ষা দিচ্ছি আর একটা প্রশ্নের উত্তরও মনে পড়ছে না। সব ভুলে গেছি। তখন মনে হয় গোল্ডেন ফাইভ হবে না। তখন ভয়ে ঘুম ভেঙে যায়। আর ঘুম আসে না।”
আম্মু বললেন, “তোকে কাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।” •
আইরিন জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না, আম্মু আমাকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে না। আমার কিছু হয় নাই। আমি ভালো আছি, একদম ভালো আছি। আমার কোনো ঝামেলা নাই আম্মু। আমি ভালো আছি।”
আম্মু তখন আইরিনকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দেন। আইরিন লম্বা হয়ে চোখ খোলা রেখে শুয়ে থাকে।
.
সকালবেলা ডাইনিং টেবিলে আম্মু দেখলেন আইরিনের চোখ লাল (চোখ সাবান দিয়ে একটু ডলে দিলেই চোখ লাল হয়ে যায়। চোখের নিচে কালি (মার্কারের কালো রং হাতে লাগিয়ে চোখের নিচে ঘষে লাগানো হয়েছে) চুল এলোমেলো (হাত দিয়ে খিমচে খিমচে চুল এলোমেলো করা হয়েছে), চোখের দৃষ্টি উদ্ৰান্ত এবং ডান হাতটা একটু একটু কাঁপছে (এই দুটো অভিনয়)। আম্মু ভয় পাওয়া গলায় বললেন, “কী হয়েছে আইরিন?”