বাচ্চারা নড়ল না, ছোটাচ্চুর কথা না শোনার ভান করে দাঁড়িয়ে রইল। টুনি বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি যেটা বলতে চাও সবার সামনে বলে ফেলো। এই বাসায় সবাই সবকিছু জানে। কোনো গোপন জিনিস নাই।”
ছোটাচ্চু আস্তে আস্তে আরো রেগে উঠল, তারপর কঠিন গলায় বলল, “আজ সকালে কেন প্যারাগন কোচিং সেন্টার থেকে ফোন করে তোর কথা আমার কাছে জানতে চাইল? কেন?”
ছোটাচ্চু কথা শেষ করতে পারল না তার আগেই বাচ্চারা চিৎকার করে উঠল, “কোচিং সেন্টার? ইয়াক থুঃ। ছি ছি ছি। ঘেন্না ঘেন্না। বমি করে দেই। টুনি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছে? হায় হায় হায়!”
টুনি বলল, “আমি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হই নাই। ছোটাচ্চুর একটা কেস সলভ করার জন্যে ছোটাচ্চু আমাকে পাঠিয়েছিল।”
বাচ্চারা তখন একটু শান্ত হয়। একজন বলল, “তাই বলো!”
আরেকজন বলল, “ভিতরে কী রকম টুনি আপু? লোকজন কি চাবুক নিয়ে থাকে?”
“ব্রেন নষ্ট করার জন্য কী জানি ওষুধ খাওয়ায় সেইটা কি সত্যি?”
“যারা যায় তার নাকি আস্তে আস্তে জম্বির মতো হয়ে যায়?”
ছোটাচ্চু হুংকার দিয়ে বলল, “তোরা তোদের ফালতু কথা বন্ধ করবি?” তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, তুই আমাকে বল, আজকে সন্ধেবেলা প্যারাগন কোচিং সেন্টারের লোকজন কেন আমার সাথে টাকার বস্তা নিয়ে দেখা করতে এসেছে? কেন আমাকে বলছে গভর্নমেন্টকে রিপোর্ট না দিতে, তাহলে আমাকে সেই টাকার বস্তা দিয়ে দিবে! তুই কী করেছিস? কী বলেছিস তাদের?”
শান্ত আনন্দে চিৎকার করে বলল, “টাকার বস্তা? কোথায় ছোটাচ্চু টাকার বস্তাটা? আমাদেরকে দেখাও!”
আরেকজন বলল, “কত টাকা ভিতরে? গুনেছ?”
শান্ত বলল, “আমাদেরকে দাও ছোটাচ্চু, গুনে দেই! খোদার কসম এক টাকাও সরাব না।”
ছোটাচ্চু হুংকার দিয়ে বলল, “তোরা কি ভেবেছিস আমি দুই নম্বরি মানুষ? কেউ টাকার বস্তা নিয়ে আসলেই আমি সেটা নিয়ে নেব?”
শান্ত বলল, “ঠিক আছে তুমি না নিলে, আমাদেরকে দিয়ে দাও! কী বলিস তোরা?”
বাচ্চারা মাথা নাড়ল। ছোটাচ্চু আরো রেগে উঠল বলল, “তোরা তোদের ফালতু কথা থামাবি?” তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “টুনি, তুই বল। কী হয়েছে?”
টুনি বলল, “ছোটাচ্চু। কিছুই হয় নাই। তুমি আইরিনকে ওয়াচ করার জন্য পাঠিয়েছ, আমি ওয়াচ করেছি। মেয়েটা খুবই সুইট। কোনোরকম সমস্যা নাই, গল্প বই পড়তে ভালোবাসে। বইয়ের শেলফে মোটেও ইয়াবা লুকিয়ে রাখে না, গল্পের বই লুকিয়ে রাখে। থ্রি কমরেডস, এরিখ মারিয়া রেমার্কের বই। এরিখ মারিয়া রেমার্ক চিনেছ তো? যে অল কোয়ায়েট ইন দা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট লিখেছিল।”
ছোটাচ্চু ধমক দিয়ে বলল, “আমাকে তোর এরিখ মারিয়া রেমার্ককে চিনাতে হবে না। যেটা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দে। প্যারাগন কোচিং সেন্টারের লোকজন কেন আমাকে টাকা ঘুষ দিতে চায়?”
টুনি হাত নেড়ে উড়িয়ে দেওয়ার মতো করে বলল, “ওটা কিছু না।”
“কিছু না মানে? কোচিং সেন্টারের লোকজন কেন আমার কাছে টাকার বস্তা নিয়ে আসবে? কী করেছিস তুই?”
টুনি মাথা নাড়ল, “কিছু করি নাই। শুধু–”
“শুধু কী?”
“যে লোকটা মডেল টেস্ট নেয় তার উচ্চারণ খুব খারাপ। প্যারাগনকে বলে ফ্যারাগন, গোলাপ ফুলকে বলে গোলাফ পুল, প্রত্যেককে বলে ফরতেক–”
বাচ্চারা হি হি করে হাসতে থাকে তখন ছোটাচ্চু তাদেরকে একটা মেগা ধমক দিল, “চুপ করবি তোরা?”
বাচ্চারা চুপ করল। ছোটাচ্চু, “উচ্চারণ খারাপ হয়েছে তো কী হয়েছে?”
টুনি মাথা নাড়ল, “কিছু হয় নাই। কিন্তু যখন বলল, পরীক্ষার আগেই তারা পরীক্ষার প্রশ্ন দিয়ে দেবে–”
“তাই বলেছে?”
“না। বলেছে ফরীক্ষার ফ্রশ্ন–মানে পরীক্ষার প্রশ্ন।”
“তখন তুই কী করেছিস?”
“তখন আমি ভান করেছি তার কথা রেকর্ড করেছি। যখন আমার ভুয়া ভয়েস রেকর্ডার কেড়ে নিতে চেয়েছে তখন তোমার আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির কথা বলে একটু ভয় দেখিয়েছি।”
বাচ্চারা চিৎকার করে বলল, “ঠিক করেছে। টুনি ঠিকই করেছে। একশ বার!”
শান্ত বলল, “প্যারাগন কোচিং সেন্টারকে জ্বালিয়ে দিতে হবে।”
আরেকজন বলল, “জ্বালো জ্বালো। আগুন জ্বালো।”
অন্যেরা বলল, “ধ্বংস হোক। ধ্বংস হোক।”
তখন সবাই চিৎকার করে উঠল, “ধ্বংস হোক ধ্বংস হোক।”
ছোটাচ্চু আরেকটা মেগা ধমক দিল, “চুপ করবি তোরা?”
বাচ্চারা চুপ করল তখন ছোটাচ্চু টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে এখন আমি কী করব?”
টুনি হাত উল্টে বলল, “তোমার ইচ্ছা!”
তারপর খুবই শান্ত ভঙ্গিতে ছোটাচ্চুর ঘর থেকে বের হয়ে এলো। বাচ্চারাও তার পিছু পিছু বের হয়ে এলো। শান্ত চিৎকার করে বলল, “টুনি টুনি টুনটুনি–”
অন্যেরা চিৎকার করে বলল, “লাল গুলাফের শুভেচ্ছা!” তারপর সবাই হি হি করে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগল।
ছোটাচ্চুর ঘরে যখন এসব ঘটছে তখন আইরিনের বাসায় সম্পূর্ণ একটা ভিন্ন নাটক মঞ্চস্থ হতে শুরু করেছে।
আইরিনের আম্মু টেবিলে খাবার দিয়ে গলা উঁচু করে আইরিনকে খেতে ডাকলেন। আইরিন তার ঘরে, কিন্তু কোনো উত্তর দিল না। তখন আম্মু আবার ডাকলেন, এবারেও আইরিন কোনো জবাব দিল না। তখন আইরিনের আব্বু ডাকলেন, “আইরিন মা, খেতে আয়।”
এবারেও কোনো জবাব না শুনে আম্মু আর আব্বু দুইজনেই তার ঘরে গেলেন। দেখলেন আইরিন তার পড়ার টেবিলে পিঠ সোজা করে বসে আছে, হাতে একটা বই ধরে রেখে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে। আম্মু আইরিনের পিঠে হাত দিয়ে ডাকলেন, “আইরিন।”