“প্ল্যান এ তাহলে কী হবে?”
“তুমি একটু আগেই বলেছ।”
আইরিন বলল, “আমি বলেছি?”
টুনি মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, বলেছ।”
“কী বলেছি?”
“তুমি বলেছ তুমি যদি বাড়ি থেকে পালিয়ে না যাও তাহলে পাগল হয়ে যাবে।”
“হ্যাঁ বলেছি। আসলেই পাগল হয়ে যাব।”
টুনি হাসি হাসি মুখে বলল, “তাহলে পাগল হয়ে যাচ্ছ না কেন? পাগল হয়ে যাও।”
“পাগল হয়ে যাব?”
“হ্যাঁ। ভান করো পাগল হয়ে যাচ্ছ।”
আইরিন কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিয়ে রইল তারপর হঠাৎ করে বুঝতে পারল টুনি কী বলছে। তার চোখ দুটো প্রথমে বড় বড় হয়ে গেল, সেখানে অবিশ্বাস, তারপর হঠাৎ করে তার সারা মুখ হাসির দমকে কেঁপে উঠল। শরীর দুলিয়ে হাসতে হাসতে টুনির পিঠে একটা থাবা দিয়ে বলল, “হায় খোদা! তোমার মাথায় এত দুষ্টু বুদ্ধি!”
টুনি বলল, “না, আইরিন এটা দুষ্টু বুদ্ধি না। বড়দের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্যে একটা রাস্তা। বড়রা আমাদের বুঝতে পারে না তো, তাই মাঝে মাঝে এ রকম একটা-দুইটা বুদ্ধি বের করতে হয়।”
“তুমি আগেও এ রকম করেছ?”
টুনি মাথা নাড়ল, “করেছি। নিজের জন্যে করতে হয় নাই, অন্যদের জন্যে করেছি। যে রকম আজকে একটু আগে–”
“একটু আগে কী?”
“ঐ যে কোচিং ক্লাসে মাইক্রো ভয়েস রেকর্ডার দিয়ে রেকর্ড করেছি।”
আইরিন চোখ কপালে তুলে বলল, “ঐটা ভুয়া?”
“হ্যাঁ।”
“ডিটেকটিভ এজেন্সি? সেটাও ভুয়া?”
“না, ওটা সত্যি। আমার ছোটাচ্চুর আসলেই একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি আছে। তবে ছোটাচ্চু কোচিং সেন্টারের দুই নম্বরি কাজকর্ম দেখার জন্যে আমাকে পাঠায় নাই।”
“তাহলে কী জন্যে পাঠিয়েছে?”
টুনি হঠাৎ করে বিপদে পড়ে গেল। ইচ্ছা করলেই সে বানিয়ে একটা উত্তর দিতে পারে, আইরিন কোনোদিন সেটা ধরতে পারবে না। কিন্তু যে মেয়েটার সাথে আইসক্রিম ভাগাভাগি করে খেতে খেতে বন্ধুর মতো গল্প করে করে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে, মায়ের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্যে প্ল্যান এ দাঁড়া করাচ্ছে, তার সাথে কেমন করে মিথ্যা কথা বলে? তাই সে সত্যি কথাটাই বলল, “আইরিন, আমার এসাইনমেন্টটা তোমাকে বলা যাবে না।”
আইরিন হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে গেল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে টুনির দিকে তাকাল তারপর মেঘ স্বরে বলল, “তুমি আমার উপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্যে গিয়েছ? ঠিক কি না? আমার আম্মু তোমার ছোটাচ্চুকে আমার উপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্যে পাঠিয়েছে। সত্যি কি না বলো?”
টুনি ইচ্ছে করলেই হেসে কথাটা উড়িয়ে দিতে পারত কিন্তু সেটা করল না। অপরাধীর মতো মাথা নেড়ে বলল, “সত্যি।”
আইরিন কয়েক সেকেন্ড টুনির দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “তুমি তাহলে আমার উপরে গোয়েন্দাগিরি না করে চলে যাচ্ছ কেন?”
ধরা যখন পড়েই গিয়েছে তখন সত্যি কথা বলাটাই ভালো। টুনি বলল, “আমার যা জানার দরকার জেনে গিয়েছি।”
“কী জেনেছ?”
“তুমি মোটেও ড্রাগ খাও না। লুকিয়ে লুকিয়ে গল্পের বই পড়ো। এখন পড়ছ এরিখ মারিয়া রেমার্কের লেখা থ্রি কমরেডস। একশ বাহান্ন পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়া হয়েছে। কোচিং ক্লাসের পিছনের শেলফের দ্বিতীয় তাকের পিছনে তুমি বইটা লুকিয়ে রাখো।”
আইরিন চোখ কপালে তুলে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল তারপর বলল, “তুমি কেমন করে জানো?”
“কোচিংয়ের ঘরটাতে বসে বসে তোমাকে লক্ষ করেছি। খুবই সোজা। আজকে তুমি আসার আগে শেলফের পিছনে বইটা দেখেছি। একশ বাহান্ন পৃষ্ঠাটা ভাজ করা ছিল।”
টুনি কথা শেষ করে আইরিনের দিকে তাকাল তারপর বলল, “তুমি কী আমার উপর রাগ হয়েছ?”
আইরিন একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, “না, তোমার উপর রাগ হয়ে কী করব। রাগ হচ্ছে আমার আম্মুর উপর। আমাকে এইটুকু বিশ্বাস করে না। দেখেছ?”
টুনি আইরিনের পিঠে বন্ধুর মতো হাত রেখে বলল, “প্লিজ, তুমি আমার উপর রাগ হয়ো না। চলো এক জায়গায় বসে তোমার প্ল্যান এ ঠিকমতো রেডি করি, যেন কোনোদিন তোমার প্ল্যান বি পর্যন্ত যেতে না হয়। তোমার প্ল্যান বি খুবই ডেঞ্জারাস।”
আইরিন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “চলো।”
.
রাত্রে দাদির (কিংবা নানি) বসার ঘরে সবাই বসে নিজের কাজকর্ম করছে। এক কোনায় বসে বাচ্চারা খেলছে। ঝুমু খালা ট্রেতে করে তার বিখ্যাত পায়েশের মতো চা নিয়ে এসেছে, সবাই কাড়াকাড়ি করে সেটা খাচ্ছে, তখন ছোটাচ্চু বসার ঘরে ঢুকল। বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বাঘের মতো গর্জন। করে বলল, “টুনি কই?”
টুনি বাচ্চাদের মাঝেই ছিল, চি চি করে বলল, “এই যে এইখানে।”
“এক্ষুনি আমার ঘরে আয়। তোর সাথে কথা আছে।”
কোচিং সেন্টারে গোলমাল পাকিয়ে বের হওয়ার পর টুনির সাথে আর ছোটাচ্চুর দেখা হয় নাই। তার মাঝে এত কিছু ঘটে গেছে যে ছোটাচ্চু রেগে যেতেই পারে। টুনির বুকের ভেতর ধুকপুক করতে থাকে, কিন্তু সে খুবই শান্ত ভঙ্গিতে ছোটাচ্চুর পিছু পিছু তার ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে। বাচ্চারা সবাই উঠে দাঁড়াল তারপর তারাও লাইন বেঁধে টুনির পিছু পিছু ছোটাচ্চুর ঘরে রওনা দিল।
ছোটাচ্চু তার ঘরে ঢুকে পিঠ সোজা করে চেয়ারে বসল, তারপর বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি টুনিকে ডেকেছি। তোদের কাউকে ডাকিনি। তোর বের হ।”
বাচ্চারা কেউ বের হবার কোনো লক্ষণ দেখাল না। যে যেভাবে দাঁড়িয়ে আছে সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকল। ছোটাচ্চু আবার গর্জন করল, “কী বলছি, কথা কানে যায় না? বের হ সবাই। গেট আউট।”