বাচ্চারা একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, শান্ত নাক কুঁচকে বলল, “গন্ধ?”
বড় চাচার ছোট মেয়ে শিউলি ফিসফিস করে বলল, “আব্বুর মনে হয় ব্লাড প্রেশার হয়েছে।”
অন্যেরা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, ব্লাড প্রেশার। নিশ্চয়ই ব্লাড প্রেশার।”
শান্ত বলল, “এই জন্যে বড় চাচার মাথা আউলে গেছে।”
বড় চাচার মাথা আউলে যাওয়া নিয়ে কাউকে অবশ্যি খুব ব্যস্ত হতে দেখা গেল না। তারা আবার খেলায় ফিরে গেল। নিঃশব্দে কিছুক্ষণ গোনাগুনি তারপর হঠাৎ হুটোপুটি, চিৎকার, মারামারি।
কিছুক্ষণ পর টুনিকে বড় চাচার কাছে দেখা গেল। বড় চাচা জিজ্ঞেস করলেন, “কী হলো, তোদের মারামারি শেষ? সবাই ঠিক আছে তো?”
“এটা মারামারি না বড় চাচা। এটা একটা বোতাম নিয়ে খেলা। যে বোতামটা পায় সে সেটা ধরে রাখতে চায়, অন্যেরা সেটা কেড়ে নেয়। সেইটাই খেলা।”
বড় চাচা বললেন, “ও।” তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “এখন বোতামটা কার কাছে আছে?”
“লিটুর কাছে ছিল, লুকিয়ে রাখার জন্যে গাধাটা মুখের ভিতরে রেখেছে। যখন কাড়াকাড়ি শুরু হলো তখন কোঁৎ করে গিলে ফেলেছে।”
বড় চাচা আঁতকে উঠে বললেন, “গিলে ফেলেছে? সর্বনাশ! এখন?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “এখন কিছু না। গাধাটা এর আগে আরেকবার যখন একটা এক টাকার কয়েন গিলে ফেলেছিল, তখন ডাক্তারের কাছে নিয়েছিল, ডাক্তার বলেছে চিন্তার কিছু নাই। বাথরুমের সাথে বের হয়ে আসবে।”
“বের হয়েছিল?”
“শান্ত ভাই বলেছে বের হয়েছে।”
“শান্ত কেমন করে জানে?”
টুনি মুখ শক্ত করে বলল, “টাকা-পয়সার ব্যাপার শান্ত ভাইয়া সবচেয়ে ভালো জানে।”
বড় চাচা কী বলবেন বুঝতে পারলেন না, টুনি বলল, “এই বোতামটা অনেক ছোট। লিটু গাধাটা হজম করে ফেলবে।”
“ডাক্তারের কাছে নিতে হলে বলিস।”
“বলব বড় চাচা।”
কথা শেষ করেও টুনি চলে গেল না, তখন বড় চাচা জিজ্ঞেস করলেন, “আর কিছু বলবি?”
টুনি মাথা নাড়ল, তখন বড় চাচা বলল, “বলে ফেল।”
“তুমি পেপারওয়ালাকে ফোন করে একটু খোঁজ নিবে সে আসলেই বাসায় পত্রিকা দিচ্ছে কি না।”
বড় চাচার কাছে টেলিফোন নম্বর ছিল, ফোন করে জানা গেল পেপারওয়ালা নিয়ম করে প্রত্যেক দিন খুব ভোরে পেপার দিয়ে যাচ্ছে। টুনি মুখ শক্ত করে বলল, “বড় চাচা, শান্ত ভাইয়াকে কোনো দায়িত্ব দিয়ে লাভ নাই। শান্ত ভাইয়ার মতো ফাঁকিবাজ মানুষ একজনও নাই। কাল থেকে আমি তোমার পেপার তুলে আনব।”
বড় চাচা বললেন, “তুই?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
বড় চাচা পুরান মডেলের মানুষ, টেলিভিশন না দেখে কিংবা কম্পিউটারে ডাউনলোড না করে সত্যিকারের পেপার পড়েন বলে টুনি মনে মনে বড় চাচাকে পছন্দ করে। ঠিক কী কারণ জানা নেই। নতুন পেপার খুলে তার ভেতর অন্য রকম একটা গন্ধ পাওয়াটাও তার কাছে মজার মনে হয়। কিন্তু এগুলো তো আর বলা যায় না, তাই সে এসব কিছুই বলল না, এমনভাবে মাথা নাড়ল যার মানে যা কিছু হতে পারে। এইভাবে কোনো কিছু না বলে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মাঝে টুনি এক্সপার্ট।
পরদিন ভোরে বাসার সামনে সিঁড়ি থেকে পেপারটা আনতে গিয়ে টুনি আবিষ্কার করল সেখানে কিছু নেই। হয় পেপারওয়ালা পেপার দেয় নাই, তা না-হলে সে দেওয়ার পর কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। পেপারওয়ালাকে ফোন করার পর সে কসম কেটে বলল যে সে পেপারটা দিয়ে গেছে।
কাজেই পরের দিন টুনি ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে ঘুমাতে গেল। এলার্ম শুনে ঘুম থেকে উঠে জানালার কাছে বসে রইল। সে ঠিকই দেখল পেপারওয়ালা তার সাইকেলের পিছনে বোঝাই করে পেপার নিয়ে তাদের বাসার সামনে থেমেছে। সাইকেলটা থামিয়ে একটা পেপার নিয়ে তাদের সিঁড়িতে রেখে আবার সাইকেলে উঠে চলে গেল। টুনি তখন ঘুম ঘুম চোখে নিচে গিয়ে দরজা খুলে পেপারটা নিতে গিয়ে দেখে সেখানে কিছু নেই! পেপারটা এর মাঝে কেউ একজন নিয়ে গেছে। মুহূর্তে টুনির ঘুম ছুটে গেল–সে ডানে বামে তাকাল, কোথাও কোনো মানুষ নেই। কী আশ্চর্য! কে নিয়েছে পেপারটা?
রাত্রিবেলা বসার ঘরে দাদি (কিংবা নানি) টেলিভিশনে একটা সিরিয়াল দেখছেন, সেখানে খুব সুন্দরী দুইজন মহিলা নানা রকম শাড়ি-গয়না পরে চিৎকার করে ঝগড়া করতে করতে একজন আরেকজনের চুল ধরে টানাটানি করছে। ঝুমুখালা দাদির (কিংবা নানির) পায়ে রসুন ভাজা এক ধরনের তেল মাখিয়ে দিতে দিতে টেলিভিশনের দৃশ্যটা দেখে আনন্দে হেসে কুটি কুটি হচ্ছে। বড় চাচা খুবই বিরস মুখে একটা পুরানো ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছেন। বাচ্চারা চামচ টানাটানি করে কী একটা খেলা খেলছে তখন টুনি বসার ঘরে হাজির হলো। সে বড় চাচার কাছে গিয়ে বলল, “বড় চাচা, কোনো একজন চোর প্রত্যেক দিন সকালে তোমার পেপার চুরি করে নিয়ে যায়।”
টুনি সবাইকে শুনিয়ে কথাটা বলতে চায়নি কিন্তু কীভাবে কীভাবে জানি সবাই কথাটা শুনে ফেলল এবং সবাই ঘুরে টুনির দিকে তাকাল। শান্ত হুংকার দিয়ে বলল, “কী বললি? আমাদের বাসা থেকে চোর পেপার চুরি করে নিয়ে যায়? এত বড় সাহস? আমি যদি চোর ব্যাটাকে খুন না করে ফেলি।”
ঝুমু খালা বলল, “কাল সকালেই আমি ঝাড় দিয়া পিটায়া খাটাশের বাচ্চা খাটাশকে সিধা করে ফেলব।”
যে সবচেয়ে ছোট সে বলল, “ধরে সোজা ক্রসফায়ার।”
আরেকজন বলল, “ধরে গণপিটুনি। সোজা গণপিটুনি।”