টুনি উত্তর না দিয়ে তার ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ছোটাচ্চুর আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির একটা কার্ড বের করে মানুষগুলোর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমার কথা বিশ্বাস না করলে এই যে কার্ডে ফোন নম্বর আছে ফোন করে দেখতে পারেন। ওয়েবসাইটটাও চেক করতে পারেন।”
টিশটাশ মহিলা কার্ডটা নিল, সবাই কার্ডটা ঝুঁকে পড়ে দেখল, তারপর নিজেদের ভেতর গুজগুজ-ফুসফুস করে নিচু গলায় কথা বলতে লাগল। তারপর একজন কার্ডটা নিয়ে বের হয়ে গেল, কিছুক্ষণ পর মুখটা কালো করে ফিরে এসে মাথা নাড়ল। টুনি বুঝতে পারল ছোটাচ্চুর সাথে ফোনে কথা বলে এসেছে, কী হচ্ছে ছোটাচ্চু কিছুই বুঝতে পারেনি কিন্তু স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে টুনি এখানে আছে।
মানুষগুলো নিজেদের ভেতর আরো কিছুক্ষণ কথা বলল। তারপর মোটাসোটা মানুষটা গলার মাঝে মধু ঢেলে বলল, “এই যে খুকি, মনে হয় আমাদের মাঝে একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। আমাদের ইনস্ট্রাক্টর ঠিক কী বলতে চেয়েছেন, সেটা কীভাবে বলেছেন আর তুমি সেটাকে কীভাবে নিয়েছ এটা নিয়ে মনে হয় একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে।”
টুনি হঠাৎ করে বুঝে গেল মানুষগুলো ভয় পেয়েছে। সে এখন ইচ্ছে করলে যা খুশি তা-ই বলতে পারবে, আরো ভয় দেখাতে পারবে। তাই কলমটা মাইক্রোফোনের মতো নিজের মুখের কাছে ধরে বলল, “আংকেল এখানে সবাইকে বলেছেন আমাদের পরীক্ষায় কী আসবে সেটা মডেল টেস্ট করিয়ে আমাদের মুখস্থ করিয়ে দেবেন। একশ ভাগ গ্যারান্টি। আমি জানতে চেয়েছিলাম আংকেল আগে থেকে কেমন করে জানবেন কোনটা পরীক্ষায় আসবে! স্কুলের পরীক্ষার প্রশ্ন তো গোপন।”
মোটাসোটা মানুষ চালবাজ মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এটা বলেছ?”
চালবাজ মানুষ খাবি খেয়ে বলল, “না মানে ইয়ে আমি শুধু বলেছি ফ্রত্যেক দিন আমরা মডেল টেস্ট নেই–”
যে কথাটা বলার জন্যে গত দুই দিন টুনির মুখটা নিশপিশ করছিল শেষ পর্যন্ত সেটা বলেই ফেলল, “আংকেল আপনি বলছেন ফরতেক, আসলে উচ্চারণটা হচ্ছে প্রত্যেক।”
কয়েক সেকেন্ড ঘরের মাঝে কেউ কোনো কথা বলল না, তারপর হঠাৎ একজন হাসি চাপতে না পেরে নাক দিয়ে বিদঘুঁটে একটা শব্দ করে ফেলল। হাসি খুবই সংক্রামক একটা ব্যাপার, তাই সেটা শুনে আরেকজন, তারপর আরেকজন, তারপর ঘরের সবাই প্রথমে চাপা তারপর জোরে জোরে হাসতে শুরু করল। চালবাজ মানুষটা প্রথমে লাল তারপর নীল তারপর বেগুনি হয়ে গেল, তারপর বেগুনির মাঝে ছোপ ছোপ লাল আর নীল রং দেখা যেতে লাগল।
টুনি বুঝতে পারল সে এখন পর্যন্ত যেটুকু করেছে সেটা অনেক বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। ছোটাচ্চু জানতে পারলে তার খবর হয়ে যাবে। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। বড় কিছু অঘটন ঘটে যাবার আগে তার এখান থেকে বের হয়ে যাওয়া উচিত। টুনি তাই কিছুই হয়নি সে রকম একটা ভাব করে খুব ধীরে ধীরে তার ব্যাগের ভিতর তার খাতাপত্র ঢোকাল, তার মোটা কলমটা রাখল, তারপর ব্যাগটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো কিছু একটা বলার চেষ্টা করল কিন্তু ঠিক কী বলবে কীভাবে বলবে বুঝতে না পেরে ইতিউতি করতে লাগল, খাবি খেতে লাগল।
টুনি ঘর থেকে বের হয়ে হেঁটে হেঁটে কোচিং সেন্টারের কুৎসিত বিল্ডিং থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে এসে বুকের ভেতরে আটকে থাকা নিশ্বাসটা বের করে দিল। কোচিং সেন্টারে এইমাত্র নাটকটা করে আসা ঠিক হলো কি না সে এখনও বুঝতে পারছে না।
রাস্তায় পা দিয়ে সে মাত্র কয়েক পা হেঁটেছে তখন সে হঠাৎ শুনল পিছন থেকে কেউ একজন তাকে ডাকছে, “এই যে, এই যে শোনো–”
টুনি ঘুরে তাকাল, দেখল আইরিন লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে হেঁটে আসছে। টুনি দাঁড়িয়ে গেল। আইরিন কাছে এসে বলল, “আমি কোচিং সেন্টারে ক্লাসটাতে ছিলাম, আমার নাম আইরিন।”
টুনি ভাবল বলে, আমি জানি! তোমার উপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্য আমি এই কোচিং সেন্টারে এসেছিলাম। কিন্তু সেটা বলল না। বলল, “আমার আসল নাম টুনি।”
“টুনি, তুমি আজকে কোচিং সেন্টারে যেটা করেছ সেটা এমনই আশ্চর্য ঘটনা যে আমি দেখে বেকুব হয়ে গেছি।”
টুনি চিন্তিত মুখে বলল, “কাজটা ঠিক হলো কি না বুঝতে পারছি না, মনে হয় বড় বড় মানুষদের সাথে বেয়াদবি করে ফেলেছি!”
“করলে করেছ। কিন্তু একেবারে সত্যি কথা বলেছ। তুমি আসলেই ডিটেকটিভ এজেন্সির মেয়ে? ডিটেকটিভ এজেন্সিতে এত ছোট মেয়ে কাজ করে?”
টুনি ফিক করে হেসে ফেলল, বলল, “আমার ছোটাচ্চুর এজেন্সি। সেই জন্যে মাঝে মাঝে ছোটাচ্চুর জন্যে কাজ করে দেই। ছোটাচ্চু অবশ্যি খুবই বিরক্ত হয়। আজকে এখানে কি হয়েছে শুনলে মনে হয় আমাকে খুনই করে ফেলবে।”
আইরিন মেয়েটা হঠাৎ হি হি করে হাসতে শুরু করল, হাসতে হাসতে কোনোমতে বলল, “ফরতেক–” তারপর আবার হাসতে শুরু করল, হাসি আর থামাতে পারে না। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে গেল। হাসি নিশ্চয়ই খুবই ছোঁয়াচে একটা বিষয়, তাই আইরিনকে দেখে টুনিরও হাসি পেয়ে গেল। এখন সেও একটু একটু করে হাসতে শুরু করল।
অনেকক্ষণ পর হাসি থামিয়ে আইরিন বলল, “কত দিন পর আমি হাসলাম। হাসতে কেমন লাগে ভুলেই গিয়েছিলাম।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “কেন তুমি হাসতে ভুলে গিয়েছ?”