“তাহলে মডেল টেস্ট এত খারাফ করছ কেন? মাত্র চল্লিশ ফেয়েছ।”
টুনি বলল, “চল্লিশ অনেক নম্বর।”
মানুষটা প্রায় আর্তনাদের মতো করে বলল, “ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারে একশতে ফচানব্বই ফেলে ফাস। তোমাদের সবকিছু মুখস্ত করতে দিয়েছি না? মুখস্ত করলা না কেন? লেখাড়া মানেই মুখস্ত। মুখস্ত মানেই লেখাড়া।”
টুনি ভাবল বলে শব্দটা লেখাড়া না, শব্দটা লেখাপড়া এবং মুখস্থ মানেই লেখাপড়া কথাটা মোটেই সত্যি না। কিন্তু কিছু বলল না, একটু পরেই এখান থেকে চলে যাবে আর কোনোদিন আসতে হবে না, শুধু শুধু। এখন কথাবার্তা বাড়িয়ে লাভ নেই। টুনি হাসি হাসি মুখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
মানুষটা দুই হাত নেড়ে প্রায় নাচার মতো একটা ভঙ্গি করে বলল, “তোমরা অন্য কোচিং সেন্টারে যাও, তারা তোমাদের উল্টাফাল্টা জিনিস মুখস্ত করতে দিবে। মুখস্ত করবে কিন্তু ফরীক্ষায় সেই জিনিস আসবে না। আমাদের ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারে কখনো সেইটা হয় না। যেটা মুখস্ত করবা সেইটাই ফরীক্ষায় ফাবে। গ্যারান্টি।”
টুনি এবারে আর চুপ করে থাকতে পারল না, বলল, “আংকেল, পরীক্ষায় কোনটা আসবে সেইটা আপনারা আগে থেকে কেমন করে জানেন?”
মানুষটা কেমন যেন একটু খাবি খেল, তারপর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, “সবাই আমাকে স্যার ডাকে, তুমি আংকেল ডাকো, ব্যাফারটা কী?”
টুনি বলল, “কিন্তু আপনি তো আমার স্যার না। যারা পড়ায় তারা স্যার। আপনি তো পড়ান না। আপনি মডেল টেস্ট নেন। মুখস্থ করার জন্যে কাগজ দেন। আপনি আংকেল।”
মানুষটা আরেকবার খাবি খেল। বলল, “আমি আংকেল?”
“হ্যাঁ।” দেখা গেল টুনির সাথে সাথে আরো অনেকে মাথা নেড়ে বলল, “আংকেল! আংকেল!”
মানুষটা এবারে কেমন জানি থতমত খেয়ে গেল। টুনি তখন আবার জিজ্ঞেস করল, “আপনি কেমন করে আগে থেকে জানেন আমাদের পরীক্ষায় কী প্রশ্ন আসবে?”
মানুষটা আস্তে আস্তে কেমন জানি রেগে উঠল, বলল, “তোমার এত কিছু জানার দরকার কী? আমরা কোন জায়গা থেকে ফরীক্ষার ফ্রশ্ন আনি সেইটা আমাদের ব্যাফার। তোমরা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছ, এখন চোখ বন্ধ করে আমাদের ফ্রশ্ন মুখস্ত করবে। বুঝেছ?”
টুনির কেমন জানি একটা জিদ চেপে গেল। সে ঠান্ডা গলায় বলল, “এক সেকেন্ড আংকেল।” তারপর ব্যাগের ভেতর থেকে তার একটু মোটা ধরনের বল পয়েন্ট কলম বের করে কলমটা অনেকটা মাইক্রোফোনের মতো করে মানুষটার দিকে ধরে বলল, “আংকেল। এখন বলেন।”
‘আংকেল’ এবারে কেমন যেন বিভ্রান্ত হয়ে গেল। একটু ভয়ে ভয়ে কলমটার দিকে তাকিয়ে বলল, “এইটা কী?”
“মাইক্রো ভয়েস রেকর্ডার। আপনি যেটা বলবেন সেইটা রেকর্ড হয়ে যাবে। বলেন আংকেল।”
মানুষটা ভয় পাওয়া গলায় বলল, “বন্ধ করো। এইটা বন্ধ করো।”
টুনি মানুষটার কথা না শোনার ভান করে বলল, “আংকেল, এখন আপনি বলেন, পরীক্ষার আগে সব প্রশ্ন আপনারা কেমন করে পেয়ে যান?”
মানুষটা হঠাৎ করে ঠোঁট চেপে মুখ বন্ধ করে ফেলল। তারপর কেমন যেন ভয়ে ভয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে শুট করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সাথে সাথে ঘরের সব ছেলেমেয়ে টুনির দিকে তাকায়, প্রথমে কেউ কোনো কথা বলে না, তারপর হঠাৎ করে সবাই একসাথে কথা বলতে শুরু করে। টুনি চোখের কোনা দিয়ে তাকিয়ে দেখল আইরিন পর্যন্ত তার বই পড়া বন্ধ করে টুনির দিকে তাকিয়ে আছে।
কিছুক্ষণের ভেতরেই দরজা দিয়ে চালবাজ মানুষটা ফিরে এলো, এবারে সে একা না, তার সাথে আরো কয়েকজন আছে। একজন মোটাসোটা, আরেকজন হালকা-পাতলা, আরেকজন টিশটাশ মহিলা। চালবাজ মানুষটা টুনিকে দেখিলে বলল, “এই মেয়েটা।”
মোটাসোটা মানুষটা বলল, “এই মেয়ে, তুমি আমাদের ইনস্ট্রাক্টরদের কথা রেকর্ড করার চেষ্টা করছ কেন? তোমার ভয়েস রেকর্ডারটা আমাকে দাও।”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু। দিব না।” তারপর মোটা বল পয়েন্ট কলমটা উপরে তুলে মাইক্রোফোনের মতো মানুষগুলোর দিকে এগিয়ে ধরল। মানুষগুলো একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, তখন টিশটাশ মহিলা বলল, “এই মেয়ে-তুমি নিজ থেকে যদি না দাও তাহলে আমাদের স্টাফ জোর করে তোমার কাছ থেকে এটা নিয়ে নেবে। তুমি আমাদের কোচিং সেন্টারে এসে আমাদের কথাবার্তা রেকর্ডিং করতে পারো না।”
টুনি বুঝতে পারল অবস্থাটা জটিল থেকে জটিল হয়ে যাচ্ছে কিন্তু যেহেতু এটা শুরু হয়ে গেছে এখন থামার উপায় নাই। টুনি একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, “আন্টি, এটা ঠিক হবে না।”
টিশটাশ মহিলা বলল, “এটা ঠিক হবে না?” তুমি কেন বলছ এটা ঠিক হবে না মেয়ে?”
চালবাজ মানুষটা বলল, “এর নাম তানিয়া জাহান। তানিয়া।”
টিশটাশ বলল, “কেন এটা ঠিক হবে না তানিয়া?”
টুনি বলল, “আসলে এটা আমার আসল নাম না। এটা ছদ্মনাম।”
মানুষগুলো একসাথে বলল, “ছদ্মনাম?”
টুনি মাথা নড়ল, বলল, “আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি থেকে আমাকে পাঠানো হয়েছে এখানে কী হয় সেটা ইনভেস্টিগেট করার জন্যে।”
সামনে দাঁড়ানো সবগুলো মানুষের চোয়াল একসাথে ঝুলে পড়ল। মোটাসোটা মানুষটা কিছুক্ষণ চেষ্টা করে বলল, “কে-কে-কেন?”
“আমি জানি না। মনে হয় গভর্নমেন্ট থেকে দায়িত্ব দিয়েছে।”
মানুষগুলোর চোয়াল এমনিতে ঝুলে ছিল আরো ঝুলে পড়ার কোনো উপায় নাই, তাই এবারে জিভগুলো একটু বের হয়ে এলো। হালকা-পাতলা মানুষটা নাকি গলায় বলল, “গভর্নমেন্ট?”