টুনি কোনো কথা বলল না।
.
পরদিন ছোটাচ্চু টুনিকে বেশ আগে প্যারাগন কোচিং সেন্টারে নামিয়ে দিয়ে গেল। টুনি ভেতরে ঢুকে তাদের ক্লাসের জন্যে ঘরটায় গিয়ে দেখে সেখানে অন্য ক্লাসের ছেলেমেয়েরা বসে মডেল টেস্ট দিচ্ছে। একটু পরেই কর্কশ একটা শব্দ হলো এবং ছেলেমেয়েরা তাদের খাতা জমা দিতে বের হতে শুরু করল। ছেলেমেয়েরা কথা বলতে বলতে হাসাহাসি করতে করতে ধাক্কাধাক্কি করতে করতে বের হচ্ছে, এই ফাঁকে টুনি ক্লাসের ভেতর ঢুকে ক্লাসের পিছনে শেলফের সামনে দাঁড়িয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে পুরানো, ছেঁড়া, বিবর্ণ গাইড বইগুলো দেখার ভান করতে থাকে। আইরিন নামের মেয়েটা শেলফের পেছনে হাত দিয়ে সেখান থেকে কোনো একটা কিছু বের করে এনেছিল। টুনি একটা গাইড বই বের করার ভান করে পিছনে হাত দেয়। হাতে কিছু একটা লাগল, জিনিসটা ধরতেই বুঝে গেল একটা বই। টুনি বইটা বের করে আনে, বইটার নাম থ্রি কমরেডস, বইয়ের লেখকের নাম এরিখ মারিয়া রেমার্ক!
কী আশ্চর্য! মেয়েটা লুকিয়ে লুকিয়ে বই পড়ে আর সবাই সন্দেহ করছে সে ড্রাগস খায়! টুনি বইয়ের কয়েকটা পৃষ্ঠা উল্টে দেখল, এই লেখকের আরো কয়েকটা বইয়ের নাম দেয়া আছে, একটা বইয়ের নাম, অল কোয়ায়েট ইন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট! টুনি এই বইটার নাম শুনেছে, লেখক নিশ্চয়ই বড় লেখক। বইটা জার্মান ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করা, লেখক নিশ্চয়ই জার্মান। একেবারে তার বয়সী এই ছোট মেয়েটা এত বড় বড় বই পড়ে আর তার মা ভাবছে সে বুঝি ড্রাগস খায়! কী আশ্চর্য! শুধু তা-ই না, তাকে ধরার জন্যে মেয়েটির মা ডিটেকটিভ লাগিয়েছে আর টুনি কী না ছোটাচ্চুর বুদ্ধি শুনে বই পড়া এই মেয়েটার পিছনে গোয়েন্দাগিরি করছে! কী লজ্জা! কী লজ্জা! টুনির একেবারে মরে যেতে ইচ্ছে করল।
টুনি এদিক-সেদিক তাকিয়ে বইটা শেলফের পিছনে যেখানে পেয়েছিল সেখানেই রেখে দিল। তার কাজ শেষ, এখন সে চলে যেতে পারে, ছোটাচ্চুকে বলতে পারে আইরিন নামে মেয়েটি মোটেও ড্রাগ খাওয়া মেয়ে নয়। মেয়েটি বই পড়তে ভালোবাসে, বাসায় যেহেতু বই পড়তে দেয় না তাই যেখানে সুযোগ পায় সেখানেই লুকিয়ে লুকিয়ে বই পড়ে। কিন্তু ছোটাচ্চু এক ঘণ্টা পর তাকে নিতে আসবে, আগে বের হয়ে গেলে তাকে না পেয়ে ছোটাচ্চু ঘ্যানঘ্যান শুরু করবে। তাকে এখন অপেক্ষাই করতে হবে। শুধু যে অপেক্ষা করতে হবে তা নয়, চালবাজ মানুষটার ভুল উচ্চারণে কথাবার্তা শুনতে হবে। কীভাবে ছেলেমেয়েগুলো এই ঘরটার মাঝে গাদাগাদি বসে দিনের পর দিন এ রকম একজন মানুষের কথা শুনে?
টুনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজার কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসে পড়ল। একসময় ছেলেমেয়েরা আসতে শুরু করে। নিজেদের ভেতর কথা বলতে বলতে ঘরটার মাঝে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসতে থাকে। একসময় আইরিনও ঘরটাতে ঢুকল। ঘরের পিছনে শেলফের সামনে গিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে শেলফের পিছনে হাত দিয়ে তার বইটা বের করে আনল। তারপর ঘরের একেবারে কোনার সিটটাতে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে বইটি পড়তে শুরু করে। মনে হয় তার চারপাশে কী ঘটছে সে তা কিছুই শুনছে না–এখানে থেকেও সে এখানে নেই।
কিছুক্ষণ পর কর্কশ একটা এলার্মের মতো শব্দ হলো আর প্রায় সাথে সাথেই গতকালকের সেই চালবাজ মানুষটা এক গাদা কাগজপত্র নিয়ে হাজির হলো। টেবিলের উপর কাগজপত্রগুলো রেখে সে ঘরের মাঝে গাদাগাদি করে বসে থাকা ছেলেমেয়েগুলোর দিকে তাকাল, তারপর গলা
পরিষ্কার করে বলল, “ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারে তোমাদের লাল গোলাফের শুভেচ্ছা।”
টুনি একটা নিশ্বাস ফেলে ভাবল যে মানুষের উচ্চারণ এত খারাপ সে কেন মুখ খুলে?
মানুষটার অবশ্যি উচ্চারণ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই, দাঁত বের করে হেসে বলল, “আমাদের ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারের বৈশিষ্ট্য কী বলো।”
কেউ কোনো কথা বলল না, মাছের মতো চোখের পাতি না ফেলে সবাই মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটা বলল, “আমাদের কোচিং সেন্টারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমাদের মডেল টেস্ট। আমরা ফরতেক দিন মডেল টেস্ট নেই।”
টুনি অবাক হয়ে লক্ষ করল মানুষটা গতকাল যে কথাগুলো বলেছিল আজকেও সেই একই কথাগুলো বলছে! টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের মতো, একই কথা একইভাবে প্রত্যেক দিন সবাইকে শোনানো হয়। কী আশ্চর্য। কোচিং সেন্টারে না এলে টুনি জানতেই পারত না এখানে কী হয়। টুনি মানুষটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে ক্লাসের অন্যান্যদের লক্ষ করতে লাগল, কত রকম ছেলেমেয়ে, কত আশ্চর্য তাদের মুখের ভঙ্গি। মানুষটা তার বিচিত্র উচ্চারণে টানা কথা বলে যেতে লাগল, টুনি না শোনার চেষ্টা করে অন্যমনস্কভাবে বসে রইল।
“তানিয়া জাহান। তানিয়া–”
টুনি অন্যমনস্ক হয়ে ছিল বলে লক্ষ করেনি মানুষটা তাদের মডেল টেস্টের খাতাগুলো ফেরত দিচ্ছে। নাম ডাকা মাত্র সবাই তাদের খাতা নিচ্ছে কিন্তু তানিয়া জাহানের খাতাটি কেউ নিচ্ছে না এবং তখন টুনির মনে পড়ল এই কোচিং সেন্টারে তার নাম তানিয়া জাহান। সে হাত তুলে দাঁড়াল।
মানুষটা খাতা নিয়ে এগিয়ে এসে বলল, “মডেল টেস্টের ফরীক্ষায় তোমার কী সমস্যা হয়েছে?”
টুনির ইচ্ছা হলো বলে, শব্দটা ফরীক্ষা না, শব্দটা হচ্ছে পরীক্ষা। কিন্তু সেটা বলল না, বলল, “আমার কোনো সমস্যা নাই।”