টুনি মনে মনে একটা নিশ্বাস ফেলল, মানুষটা শুধু যে প্রশ্নকে ফ্রশ্ন বলে তা নয়, ফাইভকে বলে পাইভ! কী ভয়ঙ্কর!
মানুষটা হাতের কাগজটা নাড়াতে নাড়াতে বলতে থাকল, “ফ্যারাগন কোচিং সেন্টার থেকে আমরা সেটা গ্যারান্টি দেই। আমাদের গ্যারান্টি কঠিন গ্যারান্টি, গোল্ডেন না ফেলে টাকা পেরৎ!”
আবার ফেরতকে বলেছে পেরৎ! মানুষটা চোখ বড় বড় করে ঘরের ভেতর গাদাগাদি করে বসে থাকা সবার দিকে তাকাল, মনে মনে হয়তো আশা করেছিল সবাই বুঝি হাততালি দিবে! কিন্তু কেউ কিছু বলল না।
মানুষটা মুখ গম্ভীর করে জিজ্ঞেস করল, “আমরা লেখাড়া করি কী জন্যে?”
কেউ এবারেও কোনো কথা বলল না, সবাই মডেল টেস্ট দিতে এসেছে, সেটা দিয়ে চলে যাবে, কথাবার্তার মাঝে কারো উৎসাহ নেই। মানুষটা অবশ্যি হাল ছেড়ে দিল না, আবার জিজ্ঞেস করল, “বলো, আমরা লেখাড়া করি কী জন্যে?”
একজন খুবই অনিচ্ছার সাথে বলল, “শেখার জন্যে।”
মানুষটা মনে হলো ইলেকট্রিক শক খেয়েছে, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “নো নো নো নো! শেখার জন্যে লেখাড়া করে বোকারা! অনেক কিছু শিখে বোকার মতো ঘরে বসে থাকে। বুদ্ধিমানরা লেখাড়া করে ফরীক্ষায় নম্বর ফাওয়ার জন্যে। শুধু ফরীক্ষায় তারা গোল্ডেন এ ফ্লাস ফায় না, জীবনের সব জায়গায় গোল্ডেন এ ফ্লাস ফায়। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়। লক্ষ লক্ষ টাকা বেতনের চাকরি করে। দেশে-বিদেশে যায়। গাড়ি-বাড়ি থাকে। ভালো ঘরে বিয়ে হয়।” (বিয়ের কথা শুনে এক-দুইজন অবশ্যি ফিক করে হেসে দিল)
মানুষটা মুখ গম্ভীর করে বলল, “আর যারা শেখার জন্যে লেখাড়া করে তাদের কী হয়? তারা স্কুল-কলেজে চাকরি করে। মাসের শেষে কোনোবার বেতন ফায় কোনোবার বেতন ফায় না। ফ্রাইভেট টিউশনি করে।”
মাঝখান থেকে কে যেন বলে উঠল, “আপনার মতো?”
সবাই তখন হি হি করে হেসে ওঠে। মানুষটা রেগে উঠে বলল, “কে বলেছে? কে?”
কেউ উত্তর দিল না, শুধু হাসিটা কেমন জানি নিঃশব্দ একটা হাসিতে পাল্টে গেল। মানুষটার উৎসাহ হঠাৎ করে কেমন জানি একটু থিতিয়ে গেল, সে আর বক্তৃতা না বাড়িয়ে সবাইকে মডেল টেস্টের প্রশ্ন দিতে থাকে।
টুনি মাথা ঘুরিয়ে একবার আইরিনকে দেখল। ক্লাসে যে এত কিছু হয়ে যাচ্ছে মনে হয় সে লক্ষই করছে না। একমনে মাথা গুঁজে কিছু একটা পড়ে যাচ্ছে। মডেল টেস্টের প্রশ্নটা পেয়েও সে সেটা সরিয়ে রাখল, মনে হলো উত্তর দেয়ার ইচ্ছাও নেই!
টুনি যদি মডেল টেস্টের উত্তর না দেয় কোনো ক্ষতি নেই, কিন্তু সে মোটামুটি মাথা খাঁটিয়ে মডেল টেস্টের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করতে লাগল। কিছু সে জানে, সেগুলো নিয়ে সমস্যা নাই। যেগুলো জানে না সেগুলো সে লটারি করে ঠিক করল। অন্যদের শেষ করতে সময় লাগছে, টুনির মোটেই সময় লাগল না।
মডেল টেস্টের উত্তরগুলো নিয়ে মানুষটা সবাইকে সঠিক উত্তর লেখা একটা কাগজ দিয়ে মুখস্থ করতে লাগিয়ে দিল। কী ভয়ঙ্কর একটা ব্যাপার! সবাই মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে যখন উত্তর মুখস্থ করছে তখন টুনি আবার পিছনে বসা আইরিনকে তার খাতায় লাগানো আয়না দিয়ে লক্ষ করল, সে এখনও গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছে, মুখস্থ করার দিকে তার কোনো আগ্রহ নেই।
শেষ পর্যন্ত আবার সেই কর্কশ এলার্মের মতো শব্দ হলো এবং সবাই তখন তাদের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। টুনিও উঠে আইরিনকে লক্ষ করার চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু ভিড়ের মাঝে তাকে দেখা গেল না। টুনি একটু অপেক্ষা করে, যখন ভিড় কমে গেল তখন দেখল আইরিন নেই। আগেই চলে গেছে। টুনি পেছনের শেলফে পুরানো গাইড বইগুলোর পিছনে কিছু আছে কি না হাত দিয়ে দেখতে চাইছিল কিন্তু তার সুযোগ পেল না। দুইজন ছেলে সেখানে দাঁড়িয়ে ক্রিকেট খেলা নিয়ে এমনভাবে কথা বলতে শুরু করল যে আর নড়ার লক্ষণ নেই। টুনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কিন্তু ততক্ষণে অন্য ক্লাসের ছেলে-মেয়েরা ঢুকতে শুরু করেছে। টুনি বাধ্য হয়ে তখন ঘর থেকে বের হয়ে গেট খুলে কোচিং সেন্টারের বাইরে এলো। রাস্তার উল্টা পাশে ছোটাচ্চু দাঁড়িয়ে আছে। টুনি ডানে-বামে তাকিয়ে রাস্তা পার হয়ে ছোটাচ্চুর কাছে যেতেই ছোটাচ্চু নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু দেখলি?”
টুনি বলল, “সে রকম কিছু না। শুধু”
“শুধু কী?”
“মেয়েটা ঘরটাতে ঢুকেই শেলফের বইয়ের পিছনে হাত দিয়ে কিছু একটা নিয়েছিল।”
ছোটাচ্চুর চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, হাতে কিল দিয়ে বলল, “ফ্যান্টাস্টিক লিড! কী নিয়েছে জানিস না?”
“উঁহু, দেখতে পারি নাই।”
“সমস্যা নাই, কালকে দেখবি। একটু আগে আগে চলে যাবি।”
“ঠিক আছে। কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
টুনি বলল, “এই কোচিং সেন্টারে যদি আমাকে কয়েক দিন যেতে হয় তাহলে আমি পাগল হয়ে যাব। কালকেই শেষ।”
ছোটাচ্চু বলল, “যদি কালকের মধ্যে কেস সলভ করতে পারিস তাহলে তো তোকে আর কোনোদিন যেতে হবে না।”
টুনি কোনো কথা না বলে চুপচাপ ছোটাচ্চুর সাথে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে ছোটাচ্চু বলল, “অফিসে চল, তোকে নানা ধরনের ড্রাগস চিনিয়ে দিই। কাল যদি কিছু একটা পেয়ে যায় তাহলে যেন চিনতে পারিস।”
টুনি বলল, “ঠিক আছে।”
ছোটাচ্চু মুখটা দার্শনিকের মতো করে বলল, “আমি বুঝতে পারি না, এই বয়সের বাচ্চারা কেমন করে ড্রাগস নেয়া শিখে যায়? কী সর্বনাশ!”