টুনি মাঝামাঝি একটা জায়গায় বসে, এখান থেকে দরজাটার দিকে তাকিয়ে কে আসছে সে দেখতে পারবে। ছেলে-মেয়েরা আসতে শুরু করেছে। বেশিরভাগই একজন আরেকজনকে চিনে, নিজেদের ভেতর কথাবার্তা বলছে। টুনি সরাসরি কারো দিকে তাকাচ্ছিল না কিন্তু খুবই মনোযোগ দিয়ে কে কী নিয়ে কথা বলছে সেটা শোনার চেষ্টা করতে থাকে। বেশিরভাগ কথাবার্তাই ফেসবুক, স্ট্যাটাস, লাইক এই সব নিয়ে। একটা দুইটা হিন্দি সিনেমার নাম শোনা গেল। স্কুলের স্যার-ম্যাডামদের গালাগাল করাও মনে হলো এদের খুব প্রিয় একটা কাজ। টুনি যদিও আইরিন মেয়েটার ছবিগুলো খুব ভালোভাবে দেখে এসেছে কিন্তু যখন সামনাসামনি দেখবে তখন চিনতে পারবে কি না বুঝতে পারছিল না। চেনা মানুষের ছবি দেখে চেনা যায়, অপরিচিত মানুষকে ছবি দেখে সে রকম চেনা যায় না।
কিন্তু আইরিন দরজা দিয়ে ঢোকা মাত্র সে তাকে চিনতে পারল। মেয়েটার চেহারার মাঝে একধরনের উদাসীনতা, মনে হয় নিজের দিকে সে নজর দেয় না। জামা-কাপড় কেমন যেন অগোছাল। এলোমেলো চুল, চোখে চশমা। আইরিন ঢুকে কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা পিছনে চলে গেল। সবার পিছনে এক কোনায় টেবিলে ব্যাগ রেখে সে এদিক-সেদিক তাকিয়ে দেখল। টুনি তখন আইরিনের উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিল। এখন সোজাসুজি তাকানো ঠিক হবে না। টুনি ব্যাগ থেকে একটা খাতা বের করল, খাতার মাঝখানে একটা ছোট চারকোনা আয়না টেপ দিয়ে লাগিয়ে এনেছে, আয়নাটা মেজ চাচির মেক-আপের কমপ্যাক্ট থেকে নেয়া। গাড়ির আয়নার মতো কনভেক্স মিরর হলে আরো ভালোভাবে অনেকটুকু জায়গা দেখা যেত, কিন্তু এখন এটা দিয়েই কাজ চলে যাবে, আইরিনের দিকে না তাকিয়েই সে আইরিনকে দেখতে পারবে। টুনি খাতাটা একটু নাড়াচাড়া করে আয়নার ভেতর দিয়ে আইরিনকে লক্ষ করতে থাকে। মেয়েটা এদিক-সেদিক তাকিয়ে যখন নিশ্চিত হলো কেউ তাকে লক্ষ করছে না, তখন সে পিছনের বইয়ের শেলফের কাছে গিয়ে গাদাগাদি করে রাখা ছেঁড়া, ময়লা, পুরনো গাইড বইগুলোর পিছনে হাত দেয়, মনে হয় সেখান থেকে সে কিছু একটা নেবে। কী হতে পারে সেটা? ড্রাগস?
ঠিক কী নেবে টুনি দেখতে পারল না কারণ ঠিক তখন তার পাশের মেয়েটি তাকে জিজ্ঞেস করল, “কী দেখো আয়না দিয়ে?”
টুনি তার খাতায় লাগানো আয়নাটা লুকানোর কোনো চেষ্টা করল না, মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বলল, “আয়নায় মানুষ কী দেখে?”
“চেহারা?”
“হ্যাঁ।” টুনি এবারে আয়নায় নিজের চেহারা দেখার ভান করে মেয়েটার দিকে তাকাল, বলল, “আমার আই শ্যাডোটা মুছে গিয়েছে, তাই না?”
মেয়েটা একবার টুনির দিকে তাকাল তারপর ফিক করে হেসে ফেলল, বলল, “তোমার এত বড় চশমা, আই শ্যাডো দেখাই যায় না।”
“বড় হলে আমি কন্টাক্ট লেন্স পরব।”
“কন্টাক্ট লেন্স? চোখের ভিতরে যেটা পরে?”
“ভিতরে না, উপরে।”
“ঐ হলো, একই কথা।” মেয়েটা কেমন জানি গা-ঝাড়া দিয়ে বলল, “কন্টাক্ট লেন্সের কথা চিন্তা করলেই আমার গা শিরশির করে।”
মেয়েটা হাসি-খুশি টাইপের, কথা বলতে পছন্দ করে। কিন্তু টুনি আজকে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে, কারো সাথে বন্ধুত্ব করে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। তাই সে আলাপ বন্ধ করার জন্যে ব্যাগের ভেতর থেকে রং পেন্সিলের বাক্স থেকে কালো পেন্সিলটা বের করে সেটা দিয়ে নিজের চোখের নিচে আই লাইনারের দাগ দেয়ার ভান করল, তারপর আয়নাটা ঘুরিয়ে সে আবার আইরিনের দিকে তাকাল, মেয়েটি ডেস্কে মাথা ঝুঁকিয়ে কিছু একটা পড়ছে। শেলফের পিছন থেকে কী নিয়েছে জানা গেল না।
ঠিক তখন, কোথায় জানি এলার্মের মতো একটা কর্কশ শব্দ হলো। ক্লাসের ছেলেমেয়েরা তখন একটু নড়েচড়ে বসল আর প্রায় সাথে সাথে দরজা দিয়ে কোচিংয়ের টিচার এসে ঢুকল–মনে হলো মানুষটা বুঝি দরজার পাশেই এলার্মের শব্দের জন্যে ঘাপটি মেরে বসে ছিল! কমবয়সী চালবাজ ধরনের একজন মানুষ, তার হাতে ফটোকপি করা অনেকগুলো কাগজ। সে কাগজগুলো টেবিলের উপর রেখে ঘরের ভেতর গাদাগাদি করে বসে থাকা ছেলেমেয়েদের দিকে তাকাল, এতগুলো ছেলেমেয়ে দেখে তার মুখে একটা আনন্দের হাসি ফুটে ওঠে। গলা পরিষ্কার করে বলল, “ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারে তোমাদের স্বাগতম। সবাইকে লাল গোলাফের শুভেচ্ছা।” মানুষটা ‘প’ উচ্চারণ করতে পারে না। প্যারাগনকে বলেছে ফ্যারাগন, গোলাপকে বলেছে গোলাফ! কী বিচিত্র!
ঘরটা ছোট, হাঁটাহাঁটি করার জায়গা নাই, তার মাঝেই মানুষটা খুব কায়দা করে পায়চারি করার ভান করে থেমে গিয়ে বলল, “আমাদের ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারের বৈশিষ্ট্য কী বলো?”
টুনির ইচ্ছে হলো বলে যে আপনারা প্যারাগনকে বলেন ফ্যারাগন! কিন্তু আসলেই তো আর সেটা বলা যায় না তাই সে চুপ করে রইল, অন্যেরাও বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল, কিন্তু ঠিক কী বলল বোঝা গেল না। মানুষটা তখন নিজেই উত্তর দিল, বলল, “আমাদের ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মডেল টেস্ট! আমরা একটার ফর একটা মডেল টেস্ট নেই, যেন কোচিং সেন্টারের ছেলেমেয়েদের সব ফ্রশ্নের উত্তর মুখস্ত হয়ে যায়।”
টুনির মুখটা নিশপিশ করতে লাগল বলার জন্যে যে শব্দটা ফ্রশ্ন’ না, শব্দটা প্রশ্ন কিন্তু এবারেও সেটা বলতে পারল না! মানুষটা টেবিলের উপর থেকে ফটোকপি করা একটা কাগজ তুলে দিয়ে সেটা উপরে তুলে সবাইকে দেখিয়ে বলল, “এই যে দেখো মডেল টেস্টের ফ্রশ্ন! তোমরা যদি এই ফ্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করতে ফারো, তোমাদের গোল্ডেন পাইভ কেউ আটকাতে পারবে না।”