“ব্যাংকে চাকরি করে।”
“আপনার হাজব্যান্ড কি জানেন আপনি আমাদের এজেন্সিতে এসেছেন?”
“না জানে না। আমার হাজব্যান্ড একেবারে অপদার্থ। সংসারের কোনো কাজকর্মে নাই। মেয়েটাকে মানুষ করার সব দায়িত্ব আমার।”
ছোটাচ্চু ইতস্তত করে বলল, “আপনার হাজব্যান্ডকে ব্যাপারটা জানালে হতো না?”
মহিলা মাথা নাড়ল, বলল “উঁহু, তাকে জানিয়ে লাভ নাই। যা করার আমাকেই করতে হবে।”
ছোটাচ্চু তখন একটা ফরম বের করে মহিলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এটা ফিল-আপ করে অফিসে জমা দিয়ে যান।”
মহিলা ফরম ফিল-আপ করে কিছু এডভান্স টাকা জমা দিয়ে চলে গেল।
ছোটাচ্চু কাহিনিটা এতটুকু বলে থেমে গেল। টুনি জিজ্ঞেস করল, “তারপর কী হয়েছে?”
ছোটাচ্চু মাথা চুলকে বলল, “আমাদের যে নতুন স্টাফ আছে তাদেরকে লাগিয়েছি। তারা আইরিনকে ছায়ার মতো ফলো করেছে কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই পায় নাই। মেয়েটা মাথা নিচু করে হেঁটে হেঁটে রিকশায় এক কোচিং সেন্টার থেকে আরেক কোচিং সেন্টারে যায়। ড্রাগের কোনো ব্যাপার যদি থাকে সেটা হয় কোচিং সেন্টারের ভিতরে, না-হয় প্রাইভেট টিউটরদের বাসায়। এখানেই আমরা আটকে যাচ্ছি, ভিতরে মেয়েটাকে ওয়াচ করতে পারছি না।”
টুনি সরু চোখে বলল, “সেই জন্যে আমাকে ডেকেছ?”
“হ্যাঁ।”
“আমাকে কী করতে হবে?”
“তুই ভিতরে গিয়ে মেয়েটাকে ওয়াচ করবি। কী করে না করে ওয়াচ করে আমাদের এসে বলবি।”
“আমি ভিতরে কেমন করে ঢুকব?” “দরকার হলে আমি তোকে ঐ কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দেব।” টুনি মুখ শক্ত করে বলল, “আমি? কোচিং সেন্টারে? কখনো না।”
“প্লিজ!” ছোটাচ্চু মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “প্লিজ টুনি, প্লিজ, এ ছাড়া আর কোনো রাস্তা নাই।”
“তাই বলে আমি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হব? বড় হলে আমার ছেলেমেয়েদের সামনে আমি কেমন করে মুখ দেখাব? তারা যদি জানে তাদের মা কোচিং সেন্টারে গেছে তাহলে লজ্জার চোটে তারা আত্মহত্যা করে ফেলবে না?”
ছোটাচ্চু কয়েক সেকেন্ড হাঁ করে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “কিন্তু তুই তো আসলে কোচিং সেন্টারে ভর্তি হচ্ছিস না।”
ঠিক তখন কয়েকজন বাচ্চা ছোটাচ্চুর ঘরে এসে ঢুকল, ছোটাচ্চু সাথে সাথে কথা বন্ধ করে ফেলল। টুনি বলল, “না, আমি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হচ্ছি না। কোচিং সেন্টারে ভর্তি না হয়ে আমি কীভাবে সেখানে ফারিয়াপুর জরিপ করব? আমাকে তো কোচিং সেন্টারে ঢুকতেই দিবে না।”
ছোটাচ্চু কী বলবে বুঝতে না পেরে আঁ আঁ ধরনের একটা শব্দ করল। টুনি বলল, “তুমি ফারিয়াপুকে বুঝিয়ে বলো যাদের কোচিং সেন্টারে যেতে হয়েছে তাদের জরিপ নিয়ে লাভ নাই। তারা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারে। কাজেই আমরা যদি কোচিং সেন্টারে জরিপ না করি কোনো ক্ষতি হবে। ফারিয়াপু তার চল্লিশ পার্সেন্ট ডাটা এমনিতেই পেয়ে যাবে। তার সাথে বাকি ত্রিশ পার্সেন্ট যোগ করলে”
বাচ্চারা এই ঘরে বসে এই রকম বিরক্তিকর কথার কচকচানি শুনতে রাজি হলো না, তারা মুখ বিকৃত করে বের হয়ে গেল। টুনি আর ছোটাচ্চু তখন আবার আগের আলোচনায় ফিরে গেল, ছোটাচ্চু বলল, “তুই তো আর সত্যি সত্যি কোচিংয়ে ভর্তি হচ্ছিস না। তুই একটা মেয়েকে সাহায্য করার চেষ্টা করছিস!”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “তাতে কী আছে ছোটাচ্চু, সবাই জানবে আমি কোচিং করি! কোচিংয়ের খাতায় আমার নাম লেখা হয়ে যাবে। ছিঃ!”
ছোটাচ্চু বলল, “ঠিক আছে, তোকে একটা ভুয়া নামে ভর্তি করে দেব। কোচিংয়ের খাতায় তাহলে তোর আসল নাম উঠবে না।”
টুনি কিছুক্ষণ চিন্তা করল, তারপর তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে চোখের চশমাটা ঠিক করে বলল, “ঠিক আছে তাহলে!”
.
পরদিন ছোটাচ্চুর সাথে টুনি বাসা থেকে বের হলো, অনেক সকাল হওয়ায় বাচ্চাদের বেশিরভাগ তখনো ঘুমে, তাই তারা সেটা টের পেল না। ছোটাচ্চু প্রথমে তাকে তার অফিসে নিয়ে আইরিনের ছবিগুলো দিল। ছবিগুলো ভালো করে দেখে টুনি তার ব্যাগের ভেতর সেগুলো ঢুকিয়ে নিল। ছোটাচ্চু তখন প্যারাগন কোচিং সেন্টারে ফোন করে একটু খোঁজখবর নিয়ে টুনিসহ সেখানে রওনা হলো।
টুনি ভেবেছিল কোচিং সেন্টারে ভর্তি হওয়ার জন্যে তারা টুনির কাগজপত্র দেখতে চাইবে কিন্তু সে রকম কিছু হলো না, মনে হলো কেউ টাকা দিতে রাজি হলেই তাকে তারা ভর্তি করে নেয়। আইডি কার্ড বানানোর জন্যে একটা ফটো চাইল, টুনি বলল, পরদিন নিয়ে আসবে। প্যারাগন কোচিং সেন্টারে টুনির নাম হলো তানিয়া জাহান, সংক্ষেপে তানিয়া।
টুনিকে কোচিং সেন্টারে ঢুকিয়ে ছোটাচ্চু চলে গেল, টুনি তখন আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকল। এই প্রথম সে একটা কোচিং সেন্টারে এসেছে। সে জীবনেও চিন্তা করেনি যে সে এ রকম একটা জায়গায় আসবে। একসাথে অনেকগুলো ঘরে ব্যাচে ব্যাচে কোচিং হয়। টুনি খোঁজখবর নিয়ে ক্লাস সেভেনের ঘরটাতে ঢুকল। সারি সারি গ্রাস্টিকের চেয়ার, সামনে একটা ডেস্ক। ডেস্কের উপর কলম দিয়ে এবং মার্কার দিয়ে কোচিংয়ের ছাত্রছাত্রীরা তাদের নানা রকম মন্তব্য লিখে গেছে, ছবি এঁকে গেছে। সেগুলো পড়ে পড়েই মনে হয় সময়টা পার করে দেয়া যাবে। ঘরের সামনের দেওয়ালে একটা হোয়াইট বোর্ড ঝুলানো, পিছনে একটা শেলফ, ময়লা-বিবর্ণ গাইড বই দিয়ে ঠাসা, দেখেই মন খারাপ হয়ে যায়। ঘরের দেওয়াল ময়লা, কোনায় কোনায় মাকড়সার জাল। মেঝেতে চিপসের খালি প্যাকেট, বাদামের খোসা, নানা ধরনের লিফলেট, মনে হলো আধখাওয়া সিগারেটের একটা টুকরাও আছে। তবে ঘরটার সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হচ্ছে তার বোটকা গন্ধ।