- বইয়ের নামঃ আবারো টুনটুনি ও আবারো ছোটাচ্চু
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ পার্ল পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
একজন দুর্ধর্ষ পেপার চোর
আবারো টুনটুনি ও আবারো ছোটাচ্চু
ভূমিকা
কিশোর আলোতে প্রথমে “টুনটুনি ও ছোটাচ্চু” নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলাম। বছর শেষে সেগুলো দিয়ে একটি বই লেখা হলো। আমি ভাবলাম, আমার কাজ শেষ-আর লিখতে হবে না কিন্তু আমার বাচ্চাকাচ্চা পাঠকেরা টুনটুনি এবং ছোটাচ্চুর গল্পের জন্যে এমন চাপ দিতে থাকলো যে, আমি আবার কিছু গল্প লিখলাম। বছর শেষে আবার একটা বই বের হলো, সেই বইয়ের নাম দিলাম “আরো টুনটুনি ও আরো ছোটাচ্চু” তখন ভাবলাম, এবারে সত্যি সত্যি লেখা শেষ–আর লিখতে হবে না! বাচ্চারা কিন্তু চাপ থামাল না, চাপ দিতেই থাকল, তখন বাধ্য হয়ে আবার লিখতে থাকলাম–সবাই যেন পড়তে পারে সে জন্যে এগুলো লিখেছি আমার ওয়েব সাইট www.mzi.rocks এ! বছর শেষে আবার বইটা বের হলো, এবারে নাম দিয়েছি “আবারো টুনটুনি ও আবারো ছোটাচ্চু” আশা করছি এবারে সত্যি সত্যি টুনটুনি ও ছোটাচ্চুকে নিয়ে লেখা শেষ!
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
২৩.০১.২০১৭
.
একজন দুর্ধর্ষ পেপার চোর
বড় চাচা এদিক-সেদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আজকের পেপারটা কই?”
বড় চাচার প্রশ্নের কেউ উত্তর দিল না, কেউ উত্তর দিবে বড় চাচা সেটা অবশ্যি আশাও করেননি। বড় চাচা নরম টাইপের মানুষ, হাসি-খুশি থাকেন, গলা উঁচিয়ে কথা বলেন না, চিৎকার করেন না, তাই কেউ তার কথার উত্তর দেয় না! বড় চাচা আবার জিজ্ঞেস করলেন, “দেখেছিস কেউ?”
বাচ্চারা মেঝেতে উবু হয়ে কী একটা খেলা খেলছিল, দেখে খুবই নিরীহ খেলা মনে হলেও হঠাৎ হঠাৎ সবাই মিলে মারামারি শুরু করে, দেখে মনে হয় পারলে বুঝি একজন আরেকজনের চোখ তুলে নেবে। তারপর আবার শান্ত হয়ে আঙুল দিয়ে কিছু একটা গুনতে থাকে। তারপর আবার মারামারি শুরু করে। ভয়ঙ্কর একটা মারামারি শেষ করে একজন বড় চাচার প্রশ্নের। উত্তর দিল, বলল, “না বড় মামা।”
বড় চাচাকে সবাই বড় চাচা বলে না, অনেকে বড় মামা বলে। কেউ কেউ বড় ফুপা ডাকে। তার মানে এই নয় যে সবাই সম্পর্ক ঠিক করে ডাকাডাকি করে–এই বাসায় যার যাকে যা ইচ্ছা সেটা ডাকে। বড় চাচার ছোট মেয়েটা তাকে মাঝে মাঝে বড় আব্বু ডেকে ফেলে।
বড় চাচা বললেন, “এই শান্ত, তোকে বলেছি না সকালবেলা পেপারটা তুলে এনে ভিতরে রাখবি?”
শান্ত সতর্ক দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে আঙুল দিয়ে কিছু একটা হিসাব করতে করতে বলল, “বলেছ।”
“তাহলে?”
“তাহলে কী?”
“তাহলে তুলে আনিস না কেন?”
“পেপার না দিলে আমি কোত্থেকে তুলে আনব? কালকেও পেপার দেয় নাই, আজকেও দেয় নাই।”
বড় চাচা একটু অবাক হয়ে বললেন, “কী বলছিস? পেপারওয়ালা পেপার দিচ্ছে না?”
কোনো একজন উত্তর দেয়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু বাচ্চারা আবার হুটোপুটি করে মারামারি শুরু করে দিল। অন্য কারো বাসা হলে এই মারামারি বন্ধ করার চেষ্টা করত, কিন্তু এই বাসায় কেউ চেষ্টা করে না, মারামারি শেষ হবার জন্যে অপেক্ষা করে। মারামারি শেষ হলো, তখন। একজন বলল, “না বড় মামা, পেপারওয়ালা পেপার দিচ্ছে না।”
বড় চাচা বললেন, “কী আশ্চর্য! পেপার দিবে না কেন?”
শান্ত বলল, “বড় চাচা, তুমি এ রকম পুরানা মডেলের মানুষ কেন?”
বড় চাচা ভুরু কুঁচকে বললেন, “পুরানা মডেল? আমি?”
“হ্যাঁ। তুমি। পুরানা মডেল।”
বাচ্চারা সবাই খেলা বন্ধ করে বড় চাচার দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ বড় চাচা (কিংবা বড় মামা কিংবা বড় ফুপা কিংবা বড় আব্বু) তুমি খুবই পুরানা মডেল।”
“হ্যাঁ। তুমি। পুরানা মডেল।”
“কেন আমি পুরানা মডেল?”
সবাই কিছু-না-কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু শান্ত তার অভ্যাসমতো দাবড়ানি দিয়ে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল, “কারণ তুমি এখনও কাগজের পত্রিকা পড়ো। পৃথিবীতে কেউ কাগজের পত্রিকা পড়ে না। সবাই ইন্টারনেটে পত্রিকা পড়ে।”
বড় চাচা মাথা চুলকালেন। সবাই তখন কথা বলতে শুরু করল। একজন বলল, “পত্রিকা পড়তে হবে কেন? টেলিভিশনের সামনে বসে থাকলেই সব খবর পেয়ে যাবে। বিজ্ঞাপন দেখবে, নিচে স্ক্রল করা খবর।”
আরেকজন বলল, “আসলে পড়তেও হয় না। বসে থাকলেই হয়। তুমি সব খবর শুনতে পাবে। দেখতেও পাবে।”
আরেকজন বলল, “ফেসবুক আরো ভালো। তোমার কাছে খবর আসতে থাকবে আর তুমি লাইক দিতে থাকবে।”
আরেকজন বলল, “যে খবর পত্রিকায় ছাপাতে সাহস পায় না সেই খবরও ফেসবুকে পাওয়া যায়। মনে নাই সেই দিন আমরা দেখলাম, কী ভয়ঙ্কর”
অন্যেরা তখন তাকে থামিয়ে দিল, তারা সবাই মিলে যে ভয়ঙ্কর ভিডিওটা দেখছে সেটা বড়দের জানার কথা নয়। একজন বলল, “বড় চাচা কিছু একটা পড়ে তোমার যদি পছন্দ না হয় ফেসবুকে তুমি যা ইচ্ছা বলে গালি দিতে পারবে।”
আরেকজন বলল, “মনে নাই সেই দিন শান্ত ভাইয়া কীভাবে একজনকে গালি দিল?”
শান্ত তার দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল, “চোপ।”
বড় চাচা তাদের সব কথা শুনলেন কি না বোঝা গেল না। কেমন যেন একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “কিন্তু আমি খবরের কাগজ পড়তে চাই। নতুন একটা কাগজের ভাজ খুলে সেটার দিকে তাকাতে আমার কাছে ভালো লাগে। নতুন খবরের কাগজের একটা অন্য রকম গন্ধ আছে।”