অন্ধকূপ এই নাটবাড়িতে আড়িমাও রাজাদের বংশ ভালো আলো-বাতাস না পেয়ে গুষ্ঠিসুদ্ধ লোকলস্কর সমেত অল্পদিনের মধ্যেই মরে ভূত হয়ে গেল, রইল কেবল বাড়ির চুড়োয় মস্ত একটা পাথরের আলসের উপরে খড়-কুটো দিয়ে বাসা বানিয়ে এক ঠেঙে—সে হাড়গিলের রাজা খাম্বাজং। রানীর শয়ন-ঘরের কুলুঙ্গিগুলোতে গোটাকতক লক্ষ্মী-পেঁচা কালো-পেঁচা ভুতুম-পেঁচা, রাজসভার কার্নিশে-কার্নিশে ঝুলে দলে-দলে বাদুড়, রন্ধনশালায় একটা কালো বেরাল, আর ঘি-ময়দা চাল-ডাল শাল-দোশালা ধন-দৌলতে ঠাসা নিচেকার ভাঁড়ার ঘরগুলোতে গড়বন্দি পালে-পালে গণেশের নেংটি ইঁদুর। হাড়গিলে পেঁচা বেরাল এরা সবাই ইঁদুরের শক্র হলেও গণেশের ইঁদুরকে তারা খাতির করে চলত, পৃথিবীর যেখানে যত গণেশ আছে, সবার জন্যে এই নাটবাড়ি থেকে ইঁদুর যায়, এদের কেউ কিছু বলবার যো নেই, কাজেই নেংটি ইঁদুরের দল দেশ জুড়ে নানা উৎপাত আর রাজত্ব করছিল, এই সময় কোথা থেকে তাতারি-চুয়ো এসে হানা দিয়ে, যেখানে-সেখানে গণেশ উল্টে ফেলে নেংটি বংশ ধ্বংস করতে শুরু করে দিলে।
গোলাবাড়ি, ঠাকুর-বাড়ি, গোয়ালঘর, রান্নাঘর, কাচারিঘর, হেঁসেলঘর, শোবারঘর, বসবারঘর, তোষখানা, বৈঠকখানা, দেশের সব জায়গা থেকে তাড়া খেয়ে নেংটি সরে পড়তে লাগল, লড়ায়ে হারতে থাকল, না খেয়ে মরতে লাগল; শেষে এমন হল যে, এক পুরোনো নাটবাড়ি ছাড়া গণেশের ইঁদুর আর কোথাও রইল না। গণেশের সিংহাসন টলমল করতে থাকল, মানুষে নেংটি ইঁদুর মারত বটে কিন্তু গণেশ তাতে টলেননি, কেন না এত ইঁদুর বাইরে-বাইরে জন্মাত যে, মানুষ জন্ম-জন্ম মেরেও তাদের বংশ লোপ করতে পারত না। কিন্তু নেংটিরই বড় জাত যে চুয়ো, তারা যখন এসে হানা দিয়ে পড়ল, তখন গণেশ ভেবে অস্থির হলেন।
এই চুয়োরা একেবারে চোয়াড়, যা-তা খায়, দেবতা-ব্রাহ্মণে ভক্তি মোটেই নেই, একেবারে গোঁয়ার-গোবিন্দ, দুটি-একটি করে যেন ভালোমানুষের মতো প্রথমে নদী নালার ধারে-ধারে নৌকোর খোলে এসে বাসা বাঁধলে, দেবতার মন্দিরে কিম্বা মানুষের ভাঙা ঘরের উপরে, গ্রাম-নগরের দিকেই ঘেঁষতো না—নেংটি ইঁদুরগুলো যে সব পোড়ো-বাড়ি, পতিত জমি ছেড়ে গেছে সেই জায়গাগুলোয় এসে রইল, নেংটিদের ফেলে-দেওয়া যা কিছু কুড়িয়ে খেয়ে বড় হতে লাগল। ক্রমে তারা বড় হতে-হতে শেষে নেংটিদের মাটির কেল্লাগুলো দখল করে জমিদারী ফাঁদলে, সেখান থেকে এ জমিদারী সে জমিদারী, এ পরগনা সে পরগনা, এদেশ-সেদেশ, করে সারা দেশ তারা দখল করলে। মাটির নিচেটা দখল করে মাটির উপরে চুয়োর দল লড়াই দিতে যখন বার হল, তখন নেংটিরা বুঝলে দাঁড়াবার স্থান গেছে, নিরুপায় হয়ে তারা যে ক’টা পারে তাদের পুরোনো নাটবাড়ির কেল্লায় এসে ঢুকে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করতে লাগল। নাটবাড়ির দেওয়াল মোটা, কাজেই নেংটিরা কতকটা নিৰ্ভয়ে রইল, কিন্তু চুয়োরাও ছাড়বার পাত্র নয়; তারা বছরের পর বছর যুদ্ধ চালিয়ে শেষে একদিন নাটবাড়ির উঠোনটা দখল করতে বারোজন তাতারি সওয়ার পাঠিয়ে দিলে! যুদ্ধং দেহি বলে শত্রুদল চারদিক ঘিরে লেজ আপসে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে, চারদিকে সাজ রে সাজ পড়ে গেছে—
পায় দল কলবল ভূতল টলমল
সাজল দলবল অটল তাতারি।
দামিনি তক-তক জামকী ধক-ধক
ঝকমক চমকত খরতর বারি।
ধূধূ-ধূধূধূ নৌবত বাজে,
ঘন ভোরঙ্গ ভম্-ভম্, দামামা দদদম্
ঝনন্ন ঝম-ঝম ঝাঁজে—
ধা-ধা গুড়-গুড় বাজে।
নিশান ফরফর নিনাদ ধর-ধর
তাতারি গর-গর গাজে।
ধূধূ ধম-ধম ঝাঁ-ঝাঁ ঝম্-ঝম্
দামামা দম-দম বাজে।
রণজয় ভেরী বাজে রে ঝাঁগড়-ঝাঁগড় ঝাঁ-ঝাঁ ঝাঁজে রে
মুচড়িয়া গোঁফে চলে লাফে-লাফে
খেলে উড়ো পাকে থাকে-থাকে-থাকে ঝাঁপে রে
বাজে রণ ভেরী বাজে রে।
ভয় পেয়ে মরে নেংটি হাজার-হাজার
তল গেল মান মত্তা ইঁদুর রাজার
ঘাসের বোঝায় বসি ইন্দুরানী কাঁদে
ইন্দুরায় এতদিনে পড়িয়াছে ফাঁদে
কান্দি কহে ইন্দুরানী গণেশ গোঁসাই
এমন বিপাকে কভু আর ঠেকি নাই।
এই ভাবে ইঁদুর রানী কাঁদছেন, এদিকে একশো বছরের ইঁদুরের রাজা তাতারিদের ভয়ে থরথরি কম্পমান, রানীর আঁচল ধরে মন্ত্র পড়ছেন, খট্ ভৈরবী—দ্রুত ত্রিতালি—আর কেঁদে বলছেন সুর করে:
চল-চল যাই নীলাচলে। (রে অরে যাই)
ঘটালে বিধি ভাগ্যফলে
মহাপ্রভু জগন্নাথ সুভদ্রা বলাই সাথ
দেখিব অক্ষয় বটতলে,
খাইয়া প্রসাদ ভাত মাথায় মুছিব হাত
নাচি বেড়াই কুতূহলে
ভবসিন্ধু বিন্দু জানি পার হইনু হেন মানি
সাঁতার খেলিব সিন্ধুজলে॥
নেংটির রাজা যখন কেল্লা ছেড়ে রানীকে নিয়ে পাছ-দুয়োর দিয়ে গঙ্গাসাগরের দিকে পলায়নের মতলব করছেন—লড়াই না দিয়ে, সেই সময় হাঁসের দল রিদয়কে নিয়ে দেওয়ানগিরির তলায় এসে উড়ে বসল। একদিকে নাটবাড়ির পাথরের পাঁচিল, আর একদিকে হাড়গিলের চর, এরি মাঝে জলের ধারে শুশনি কলমি শাক খেয়ে হাঁসের দল চরে বেড়াচ্ছে, এমন সময় আণ্ডামানি হাঁসের সঙ্গে দেখা, ছোট দল বড় দল দুই দলে অমনি কথাবার্তা চলল, সাঁতার খেলা আরম্ভ হল।
যোগীগোফাতে ভেড়াদের নিয়ে যে কাণ্ড হয়েছে শুনে আণ্ডামানি বললে—“তা হলে শেয়াল লোভ সহজে ছাড়বে না, নিশ্চয়ই আমাদের পিছু নেবে, আর এখন দুদিন উড়ে কাজ নেই, এইখানেই থাকা যাক, আর ব্ৰহ্মপুত্রের বাঁক ধরে মানস সাগরেও গিয়ে কাজ নেই। এইখান থেকে বাঁহাতি মোড় নিয়ে একেবারে পাহাড়ের পাশ দিয়ে সোজা উত্তরে চলাই ভালো।”