বৈরিগীর দল সেই হাঁসের পালক হংসেশ্বরীর পরমহংস-বাবাজীর কাছে হাজির করে দিলে। তিনি পালক-কটি একটা হাঁড়িতে রেখে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন—“অভূতপূর্ব ঘটনা ! হংসেশ্বরীর রাজহংস স্বশরীরে বামনদেবকে নিয়ে উপস্থিত হয়ে দুটি পালক রক্ষা করে গেছেন। সে জন্য একটি সোনার কৌটার প্রয়োজন। হিন্দুমাত্রেরই এই বিষয়ে মুক্তহস্ত হওয়া উচিত। চাঁদা আমার কাছে মঃ অঃ করিয়া পাঠাইবেন। ইতি—সুরেশ্বরের পরমহংস বাবাজী।”
মানুষদের মধ্যে যেমন খবরের কাগজ, পাখিদের মধ্যে তেমনি খবর রটাবার জন্য পাখি আছে। কোথাও কিছু নতুন কাণ্ড হলেই সেই জায়গাটার উপরে প্রথমে কাক-চিল জড়ো হয়, তারপর তাদের মুখে এ-পাখি, এপাখির মুখে ও-পাখি—এমনি এ-বন, সে-বন, এ-দেশ, সে-দেশে দেখতে দেখতে খবর রটে যায়।
কাঠবেরালির কথা আর খোঁড়া হাঁস উদ্ধারের কথা রিদয় ফিরে আসার পূর্বে হাঁসের দলে, বনে-জঙ্গলে, জলে-স্থলে কোনো জানোয়ারের জানতে আর বাকি রইল না। গাছে-গাছে তাল-চড়াই, গাং-শালিক—এরা সুরেতালে রিদমের কীর্তি-কথা ঢেঁড়া-পিটিয়ে বলে বেড়াতে লাগল:
শুন এবে অবধান পশুপক্ষিগণ।
বুড়ো-আংলা মহাকাব্য করি বিবরণ॥
কাঠবেরালি রামদাস তাহারে উদ্ধরি।
বীরদাপে চলে যথা রাজহংসেশ্বরী॥
হাঁসের পালক দুটা কেটে নিল বুড়ি।
যাহে লেখা যায় মহাকাব্য ঝুড়ি-ঝুড়ি॥
হাঁসের দুর্দশা দেখি আংলা বুড়ো ধায়।
হংসেশ্বরী ছাড়ি বুড়ি পালাল ঢাকায়॥
মোহন্ত তুলিয়া নিল হংসের কলম।
সোনা চাই বলি তাহে লেখে বিজ্ঞাপন॥
তালচটক তাল ধরে গানশালিকে কয়।
সুবচনী হাঁস নিয়ে চলিল রিদয়॥
খোঁড়া হাঁসেরে লইয়া, খোঁড়া হাঁসেরে লইয়া
রচিলাম মহাকাব্য যতন করিয়া।
আংলা বিজয় নামে কাব্য চমৎকার।
গোটা দুই শ্লোক তারি দিনু উপহার॥
সকলে শুনহ আর শুনাহ অন্যকে।
ক্ষীর হতে নীর পিয়ে ধন্য হোক লোকে॥
ইতি আংলা বিজয় মহাকাব্যে প্রথম সর্গঃ।
আজ চকা-নিকোবর ভারি খুশি। সে রিদয়কে কুর্নিস করে বললে—“একবার নয়, বার-বার তিনবার তুমি দেখিয়েছ যে পশু-পাখিদের তুমি পরমবন্ধু! প্রথমে শেয়ালের মুখ থেকে বুনো হাঁস ‘লুসাইকে’ উদ্ধার, তার পরে কাঠবেরালির উপকার, সব-শেষে পোষা হাঁসকে বাঁচানো। তোমার ভালোবাসায় আমরা কেনা হয়ে রইলেম। আর তোমায় আমরা ফেরাতে চাইনে। তোমার যদি মানুষ হতে ইচ্ছে হয় তো বল আমি নিজে গণেশঠাকুরকে তোমার জন্যে ‘রেকমেণ্ডেসন’ পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
রিদয়ের আর মোটেই মানুষ হতে ইচ্ছে ছিল না। হাঁসেদের সঙ্গে দেশ-বিদেশ দেখতে-দেখতে বড় মজাতেই সে দিন কাটাচ্ছে, তবু মানুষ-হবার রেকমেণ্ডেসনখানা না নিলে চকা পাছে কিছু মনে করে, সেই ভয়ে বললে—“মানুষ হবার সময় হলে আমি তোমাকে জানাব। এখন কিছুদিন তোমাদের সঙ্গে থাকতে আমি ইচ্ছে করেছি।”
চকা ঘাড় নেড়ে বললে—“সেই ভালো; যখন ইচ্ছে হবে বল, আমি সাট্টিফিকিট দিয়ে তোমাকে গণেশের কাছে পাঠাব। এখন হাঁসের দলে হংসপাল হয়ে থাক।” বলে চকা রিদয়ের মাথাটা ঠোঁট দিয়ে চুলকে দিলে। অমনি চারদিকে বুনো হাঁস রিদয়ের নতুন উপাধি ফুকরে উঠল—“হংপাল! হংপাল!”
বনের পাখিরা প্রতিধ্বনি করলে—“হি-রি-দ-য় হংসপাল !”