সব হাঁসের সঙ্গে ভয় পেয়ে খোড়া হাঁসও ডানা ছাড়িয়ে আকাশে উঠল; কেবল রিদয় হাঁসের ডানা থেকে ঝুপ-করে মাটিতে পড়ে চোখ-রগড়ে চেয়ে দেখলে অন্ধকারে সে একা, আর দূরে একটা কুকুর হাঁস ধরে পালাচ্ছে। অমনি রিদয় হাঁসটা কেড়ে নিতে শেয়ালের সঙ্গে ছুটল। মাথার উপর থেকে খোঁড়া হাঁস একবার হাক দিলে—“দেখে চল!” কিন্তু রিদয় তখন হৈ-হৈ করে ছুটেছে। রিদয়ের গলা পেয়ে লুসাই কতকটা সাহস পেলে, কিন্তু বুড়ো-অঙুলের মতো ছেলে কেমন করে শেয়ালের মুখ থেকে তাকে বাঁচাবে, এটা তার বুদ্ধিতে এল না। এত দুঃখেও লুসায়ের হাসি এল। সে প্যাঁক-প্যাঁক করে হাসতে-হাসতে চলল।
মাথার উপরে খোঁড়া হাঁস রিদয়ের সঙ্গে-সঙ্গে চলেছে; তার ভয়—পাছে রিদয় খানায়-ডোবায় পড়ে হাত-পা ভাঙে। কিন্তু যক্ হয়ে অবধি খুব অন্ধকার রাতেও যকের মতো রিদয় দেখতে পাচ্ছে। খানা-খন্দ লাফিয়ে দিনের বেলার মতো রিদয় সহজে ছুটেছে আর চেঁচাচ্ছে—“ছেড়ে দে বলছি, না হলে এক ইট মেরে পা খোঁড়া করে দেব!” কে তার কথা শোনে? শেয়াল এক লাফে চড়া ছেড়ে পারে উঠে দৌড়ে চলল। রিদয়ও চলেছে হাঁকতে-হাঁকতে—“মড়াখেকো-কুকুর কোথাকার! ছাড় বলছি, না হলে মজা দেখাব।”
চাঁদপুরের খেঁকশেয়াল যার নাম, আসামের জঙ্গলে হেন পাখি নেই যে তাকে জানে না। সে শহরে গিয়ে কতবার মুরগি, হাঁস ধরে এনেছে। ‘তাকে মড়াখেকো-কুকুর’ বলে এমন সাহস কার ? শেয়াল একটু থেমে যেমন ঘাড় ফিরিয়ে দেখেছে, অমনি রিদয় গিয়ে তার ল্যাজ চেপে পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিলে। মানুষটি বুড়ো-আংলা, তার কিলটি কত বড়ই বা? শেয়ালের পিঠে একটা যেন বেদানা-বিচি পড়ল! কিন্তু মানুষের মতো গলার স্বর শুনে শেয়াল সত্যি ভয় পেলে; সে ল্যাজ তুলে বনের মধ্য দিয়ে পালিয়ে চলল; আর রিদয় তার ল্যাজ ধরে টিকটিকির মতো ঝুলতে-ঝুলতে চলল—উলু-ঘাসের মধ্যে দিয়ে গা-ঘেঁষড়ে। কাঁকড়ার মতো ল্যাজে কি কামড়ে রয়েছে, সেটা দেখবার শেয়ালের অবসর ছিল না, সে একেবারে নিজের গর্তর কাছে এসে দাড়িয়ে, মুখ থেকে হাঁসটা নামিয়ে, সেটার বুকে পা দিয়ে দাড়াল, তখন তার চোখ পড়ল ল্যাজে-গাঁথা বুড়ো-আংলার দিকে! এই টিকটিকির মতো ছেলেটা-ইনি চাঁদপুরী শেয়ালকে জব্দ করবেন, ভেবে শেয়াল ফ্যাক করে মুখ-ভেংচে হেসে বলল—“এইবার তোমার মনিবকে খবর দাওগে চাঁদপুরের শেয়াল হাঁস খেয়েছে।”
ছুঁচোলো-মুখ, নাটা-চোখ দেখে এতক্ষণে রিদয় বুঝলে এটা শেয়াল। কিন্তু শেয়াল তাকে ভেংচেছে, এর শোধ সে দেবেই-দেবে! রিদয় আরো শক্ত করে তার ল্যাজ চেপে, দুই পায়ে একটা গাছ আঁকড়ে, যেমন শেয়াল হাঁ করে হাঁসটার গলা কাটতে গেছে অমনি পিছনে এক টান দিয়ে, হাঁস থেকে শেয়ালকে দু-হাত তফাতে টেনে নিয়েছে! আর সেই ফাঁকে লুসাই হাঁসও ভাঙা ডানা ঝাপটাতে-ঝাপটাতে উড়ে পালিয়েছে।
“হাঁস যাক, আজ তোকে খাব!”—বলে থেঁকশেয়ালী দাঁত-খিচিয়ে রিদয়কে ধরবার জন্যে কেবলি নিজের ল্যাজটার সঙ্গে ঘুরতে লাগল। রিদয়ও ল্যাজ আঁকড়ে চরকি-বাজির মতো শেয়ালের সঙ্গে ঘুরতে থাকল, আর বলতে লাগল—“ধর দেখি মড়াখেকো কুকুর!”
বনের মধ্যে শেয়ালে-মানুষে চড়ক-বাজি এমনতর কেউ কোনোদিন দেখেনি। প্যাঁচা, চামচিকে, এমন কি দিনের পাখিরাও তামাশা দেখতে বার হল। কিন্তু রিদয় দেখলে তামাশা ক্রমে শক্ত হয়ে উঠছে—সে নিজে শেয়ালের ল্যাজ ছাড়তে চাইলেও, শেয়াল তাকে সহজে ছাড়ে কি না সন্দেহ! খেঁকশেয়ালী পাকা শিকারী; তার গায়ের শক্তিও যেমন, বুদ্ধিও তেমনি, সাহসও কম নয়। রিদয় বুঝলে ঘুরে-ঘুরে সে নিজে যেমনি হাঁপিয়ে পড়বে অমনি টুপ-করে তাকে ধরবে শেয়াল! রিদয় একবার চারদিক চেয়ে দেখলে, হাতের কাছে কোনে বড় গাছ আছে কি না। কাছেই একটা সরু ঝাউ-গাছ বন ঠেলে আকাশে সোজা উঠেছে, ঘুরতে-ঘুরতে রিদয় সেইদিকে এগিয়ে গেল, তারপর হঠাৎ একসময় শেয়ালের ল্যাজ ছেড়ে একেবারে ঝাউ-গাছটার আগ-ডালে উঠে পড়ল। শেয়াল তখনো নিজের ল্যাজ কামড়াতে বো-বো লাঠিমের মতো ঘুরছে। রিদয় গাছের উপর থেকে চেচিয়ে বললে :
তাকুড়-তাকুড় তাকা!
যাচ্ছে শেয়াল ঢাকা!
থাকে-থাকে-থাকে
হুক্কাহুয়া ডাকে!
চাঁদপুরের কাঁকড়া-বুড়ি
কামড়েছে তার নাকে!
শেয়াল দেখলে শিকার তাকে ঠকিয়ে পালাল! সে গাছের তলায় হাঁ-করে বসে রিদয়ের দিকে চেয়ে বললে—“রইলুম এইখানে বসে, কতক্ষণে নেমে আসিস দেখি! তোকে না খেয়ে নড়ছিনে!” এক-ঘণ্টা গেল, দু-ঘণ্টা গেল, শেয়াল আর নড়ে না। ঝাউ-গাছের সরু ডালে পা ঝুলিয়ে শীতের রাতে জেগে বসে থাকা যে কি কষ্ট আজ রিদয় বুঝলে। শীতে তার হাত-পা অসাড় হয়ে গেছে, চোখ ঢুলে পড়ছে, কিন্তু ঘুমোবার যে নেই—পড়ে যাবার ভয়ে। আর বনের মধ্যে অন্ধকারই বা কত! দুহাত তফাতে নজর চলে না—মিশ কালো ঘুটঘুটে চারদিক! মনে হল যেন গাছ-পালা সব শীতে কালো পাথরের মতো পাষাণ হয়ে গেছে! একটি পাখি ডাকছে না, একটি পাতা নড়ছে না—সব নিথর নিঝুম! রিদয়ের মনে হচ্ছে রাত যেন ফুরোতে চায় না!—রিদয় আর না ঘুমিয়ে থাকতে পারে না! এই সময় ভোরের কনকনে বাতাস বইল, আর দেখতে-দেখতে ভুসো-কালির মতো রাতের রঙ ক্রমে ফিকে হতে-হতে মিশি থেকে রাঙা, রাঙা থেকে রুপোলী, রুপোলী থেকে সোনালী হয়ে উঠল। তারপর বনের ওপারে সূর্য উঠলেন। বেলায় উঠত, কাজেই সূর্যকে চিরকাল রিদয় দেখে এসেছে কাঁচা-সোনার মতো হলুদ-বৰ্ণ; সূর্য যে ক্ষেপা মোষের চোখের মতো এমন লাল টকটকে, তা তার জ্ঞান ছিল না; তার ঠিক মনে হল কে যেন রাত্তিরের কাণ্ডকারখানা শুনে রেগে তার দিকে চাচ্ছেন!