রিদয় রেগে বলে উঠল—“মাথা ফুটো করতে দিলে তবে তো? যেমন দেখব সে আসছে, অমনি আমরা সরে পড়ব না?”
দুম্বা শিং নেড়ে বললে—“তা হবার যো নেই, সে ধুলোপড়া দিয়ে সবার চোখে ধুলো দিয়ে কখন যে কাজ উদ্ধার করে যাবে তোমরা টেরও পাবে না। মনে হবে, কে তোমাদের মাথা চুলকে দিচ্ছে, তোমরা ঘুমিয়ে পড়বে আরামে। তারপর চোখ খুলে দেখবে ভেড়া হয়ে গেছ।”
চকা এগিয়ে এসে শুধোলে—“এত বোকা ছাগল বোকা মেড়ায় তার কি দরকার বলতে পার?” দুম্বা থানিক চোখ বুজে বললে—“ঠিক জানিনে, তবে শুনেছি নাকি”—বলেই দুম্বা হঠাৎ চুপ করে এদিক-ওদিক চাইতে লাগল।
রিদয় ব্যস্ত হয়ে শুধালে—“কি শুনেছ বলেই ফেল না।”
দুম্বা আরো ব্যস্ত হয়ে বললে—“চুপ-চুপ অত চেঁচিও না, কাজ কি বাবু ওসব কথায়, শেষে কি ফ্যেঁসাদে পড়ব? কে কোন দিকে শুনবে, শেষে আমাকে নিয়ে টানাটানি। যাক ও কথা, কুবরী-কুবরী”—বলে দুম্বা চোখ বুজল।
রিদয় অনেক পেড়াপীড়ি করেও কুবরী ছাড়া আর একটি কথাও বোকাছাগলের মুখ দিয়ে বার করতে পারলে না। চকা চুপিচুপি রিদয়কে বললে—“তুমিও যেমন, বোকামেড়া ও, ওর কথার আবার মূল্য আছে? নিশ্চয় ওটার মাথার গোল আছে, এস এখন খেয়ে-দেয়ে একটু বিশ্রাম করা যাক, সকালে উঠে নিজের পথ নিজে দেখা যাবে।” তারপর দুম্বার দিকে চেয়ে বললে—“মশায় যদি জানতেন আমরা আজ সারা রাস্তাটা কি কষ্টে কাটিয়ে এখানে এসেছি, তবে এই রাতে আমাদের মিছে ভয় দেখিয়ে তাড়াবার চেষ্টা না করে বরং কিছু অতিথি সৎকারের বন্দোবস্ত করে দিতেন। আমরা নিতান্ত দায়ে পড়েই এখানটায় আশ্রয় নিয়েছি, এখন উচিত হয় আপনার আর কালবিলম্ব না করে আমাদের জন্যে জলযোগ এবং তারপরে সুনিদ্রার ব্যবস্থা করে দেওয়া।”
এবারে দুম্বা অন্ধকার কোণ থেকে বেরিয়ে এসে বললে—“আপনারা আমার কথায় বিশ্বাস করছেন না, আচ্ছা আমি আপনাদের খাবার ব্যবস্থা করছি; দেখুন কি কাণ্ড হয়, তখন কিন্তু আমায় দোষ দিতে পারবেন না।”
চকা এবার সত্যিই ভয় পেলে, কোনদিক থেকে কি বিপদ আসে ভেবে চারিদিক চাইতে লাগল।
দুম্বা ডাকলে—“আসুন আহার প্রস্তুত কিন্তু দেখবেন চটপট আহার সেরে উঠবেন, না হলে ব্যাঘাত হতে পারে। আপনার আসন গ্রহণ করুন আমি এখানে দাড়িয়ে আসন-বন্ধন মন্ত্রটি পাঠ করছি।” রিদয় আর হাঁসের খেতে বসে গেল। দুম্বা মন্ত্র পাঠ করতে লাগল—
মেষ চর্মের আসন তোরে করিরে পেন্নাম
আমার এই কার্যে তুই হ রে সাবধান।
কামিখ্যার বরে তোরে করিলাম বন্ধন
এ কার্যে যেন তুই না হোস লঙ্ঘন।।
হাঁসেদের অর্ধেক খাওয়া হয়েছে এমন সময় দূরে ফেউ ডাকল। দুম্বা মন্তর জপতে-জপতে বললে—“ওই শুনছেন তো এঁরা আসছেন, এরি মধ্যে খবর হয়ে গেছে। ব্যাঘাৎ হল চটপট খেয়ে নিন” বলেই দুম্বা তাড়াতাড়ি মন্তর পড়তে লাগল:
লাগ-লাগ ফেরুপালের দন্তের কপাটি
কোনো ভূতে করিতে নারিবে আমার ক্ষতি
শীঘ্রি লাগ শীঘ্রি লাগ।
মন্তরের চোটে কেউ ঘরে ঢুকতে সাহস পেলে না বটে কিন্তু বাইরে চারদিকে ফেরুপাল চিৎকার করে কানে তালা ধরিয়ে দিতে লাগল—“হুয়া-হুয়া, খাওয়া হুয়া, হুয়া খাওয়া, হুয়া খাওয়া।”
রিদয় বললে—“এত গোল করে কে?” রিদয়ের কথা তখন আর কে শোনে? তখন দুম্বা “ব্যেঘাৎ-ব্যেঘাৎ” বলে চেঁচাচ্ছে আর ঘরের মাঝে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে, যেন সর্বনাশ হচ্ছে। রিদয় দুম্বার রকম দেখে চেঁচিয়ে বললে—“আরে মশায়, ব্যাপারটা কি খুলে বলুন না, অত বুক চাপড়ে ছুটোছুটি করচেন কেন?”
দুম্বার তখন ভয়ে মাথা ঘুলিয়ে গেছে সে কাঁপতে-কাঁপিতে বললে—“সর্বনাশ হল, হায়-হায় কি উপায়, কি উপায়!”
রিদয় আরো চটে বললে—“আরে মশায় হয়েছে কি তাই বলুন না?”
দুম্বা তখন একটু স্থির হয়ে বললে—“ওই খেঁকি-খেঁক-খেঁকি খেঁকশেয়ালী ওই তিন ফেরুপাল ওঁরা যদি আমাদের দেওয়া মুড়ো কিম্বা ভেড়ার মাংস না খেতে চান তো কি হবে এখন।”
রিদয় হেসে বললে—“এই জন্যে এতো ভয়, তা ওঁরা যদি আপনাদের মুড়ো মাংস না খান তো আপনাদেরই তো লাভ, এতে আপনার দুঃখুই বা কি, ভয়ই বা কি?”
দুম্বা শিং নেড়ে বললে—“আহা আপনি বুঝেন না, ওঁদের মুড়ো মাংস খাওয়ানো যে ভেড়াবংশের সনাতন প্রথা, সেটা বন্ধ হলে যে আমাদের জাত যাবে, আমরা একঘরে হয়ে যাব, তার করলেন কি?”
রিদয় গম্ভীর হয়ে বললে—“আগে আপনি কি করতে চান শুনি!”
দুম্বা কেঁদে বললে—“আমি এ প্রাণ আর রাখব না—আমি সমাজদ্রোহী, আমি নরকে যাব স্থির করেছি, আমি অতি হতভাগ্য।”
রিদয় দুম্বার শিংএ হাত বুলিয়ে বললে—“ওদের ঠাণ্ডা করবার কি আর কোনো উপায় নেই!”
দুম্বা ঘাড় নেড়ে বললে—“আর এক উপায়—তুষানলে জ্বলে পুড়ে মরা, কিন্তু তার চেয়ে নরককুণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়াই সহজ!”
রিদয় বলে উঠল—“কাজ আরো সহজ হয় ওই তিনটে কুকুরকে নরকে পাঠিয়ে দেওয়া!”
দুম্বা দুই চোখ পাকল্ করে অবাক হয়ে বললে—“একি সম্ভব!”
রিদয় বললে—“দেখি তোমার শিং, খুব সম্ভব এক ঢুঁয়ে তিনটেকে একেবারে নরকে চালান করে দেওয়া যায় যদি তুমি তাল ঠুকে লাগ!”
দুম্বা বলল—“তাল ঠুকে ঢুঁ লাগাতে আমি মজবুত কিন্তু ওদের দেখলেই যে আমাদের বুদ্ধি লোপ পায়, তার কি?”
রিদয় দুম্বার পিঠ চাপড়ে বললে—“তোমরা চোখ বুজে থেক—আমি যেমন বলব ‘শিং টিং চট্’ অমনি একসঙ্গে সবাই ঢুঁ বসিয়ে দিও, দেখি ওরা কি করে!”